ভারতীয় তিন পাত্তি গোল্ড নামের একটি গেমস প্রস্তুতকারণ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথভাবে বাংলাদেশে গড়ে তোলা হয় ‘উল্কা গেমস লিমিটেড’। বৈধ অনুমোদন থাকলেও গেমসের আড়ালে অবৈধ উপায়ে চলছিল কোটি কোটি টাকার লেনদেন।
র্যাব বলছে— “তিন পাত্তি গোল্ডসহ বিভিন্ন অনলাইন জুয়ার মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা দেশের বাইরে পাঠানোর মূলহোতা উল্কা গেমস লি. এর সিইও জামিলুর রশিদ জামিলসহ ছয়জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের প্রতিষ্ঠানের নামে থাকা চারটি ব্যাংকে রয়েছে ৮০ কোটি টাকা। উল্কার এমডি জামিল রশিদ গেমসের আড়ালে জুয়া আসর চালাতেন। এতে তিনি বিপুল অর্থসম্পদের মালিক হয়েছে। প্রতিষ্ঠান থেকে জামিল প্রতিমাসে দশ লাখ টাকা বেতন নিতেন। চলাফেরা করতেন বিলাসবহুল গাড়িতে। তার স্ত্রী ও সন্তান দেশের বাইরে থাকেন।‘’
সোমবার (৩১ অক্টোবর) রাজধানীর কারওয়ানবাজারে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান র্যাব মিডিয়া সেন্টারে বাহিনীর আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
তিনি বলেন, “রাজধানীর মহাখালী ও উত্তরা এলাকা থেকে গেমসের আড়ালে জুয়া পরিচালনার অভিযোগে ছয়জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। যাদের মধ্যে পাঁচজন ‘উল্কা গেমস লিমিটেড’ কর্মকর্তা এবং একজন এজেন্ট। দেশে অনলাইন ক্যাসিনোর মূলহোতা সেলিম প্রধানকে গ্রেফতারের পর র্যাব জোড়ালোভাবে জুয়ার নজরদারি শুরু করে। সাম্প্রতিক সময়ে র্যাব তথ্য পায়, কিছু ব্যক্তি দেশে গেমিং ডেভেলপমেন্টের নামে বিদেশি বিনিয়োগের আড়ালে অনলাইন জুয়ার মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা দেশের বাইরে পাঠাচ্ছে। এমন খবরে রাজধানীর মহাখালী ও উত্তরা এলাকা হতে তিন পাত্তি গোল্ডসহ বিভিন্ন অনলাইন জুয়ার আড়ালে দেশের বাইরে প্রায় ২০০ কোটি টাকা পাঠানোর মূলহোতা ও উল্কা গেমস লিমিটেডের সিইও জামিলুর রশিদকে গ্রেফতার করা হয়।
গ্রেফতার বাকিরা হলেন- সায়মন হোসেন, রিদোয়ান আহমেদ, রাকিবুল আলম, মুনতাকিম আহমেদ ও কায়েস উদ্দিন আহম্মেদ।
তারা সবাই প্রতিষ্ঠানটি থেকে মোটা অঙ্কের বেতন নিতেন। তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ল্যাপটপ, সিপিইউ, সার্ভার স্টেশন, হার্ড ডিস্ক, স্ক্যানার, ডিভিডি ড্রাইভ, বিভিন্ন ব্যাংকের চেক বই, ডেভিট ও ক্রেডিট কার্ড এবং পাসপোর্ট, জাতীয় পরিচয়পত্র ও নগদ টাকা জব্দ করা হয়েছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা অনলাইন জুয়ার মাধ্যমে বিপুল পরিমান টাকা বিদেশে পাঠানোর কথা স্বীকার করেছে।
যেভাবে ব্যবসা শুরু
উল্কা গেমস লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও জামিলুর রশিদ। ২০১৭ সালে পার্শ্ববর্তী দেশের একটি প্রতিষ্ঠান মুনফ্রগ ল্যাবের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। পরে ২০১৮ সালে মুনফ্রগ ল্যাবের বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে দেড় লক্ষাধিক টাকা বেতনে নিযুক্ত হয়।
মুনফ্রগ ল্যাবের অনলাইন জুয়া অ্যাপ ‘তিন পাত্তি গোল্ড’ এর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাওয়ায় গেমটিকে আর ছড়িয়ে দিতে দেশে বৈধতার জন্য কতিপয় আইনজীবীর পরামর্শে সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে ২০১৯ সালের শুরুর দিকে জামিরুল রশিদ ‘উল্কা গেমস প্রা. লি.’ নামে একটি গেমিং ডেভেলপমেন্ট প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন নেয়। ২০১৯ সালে মুনফ্রগের শূন্য দশমিক শূন্য এক শতাংশ উল্কা গেমসকে দেওয়ার মাধ্যমে দেশে গেমিং খাতে উন্নয়নের জন্য প্রায় দেড় কোটি টাকায় চুক্তিবদ্ধ হয়। দেশে গেইম ডেভেলপমেন্টের অনুমোদন থাকলেও অনলাইন জুয়া বা ক্যাসিনোর অনুমোদন না থাকায় উল্কা গেমস বিভিন্ন ভুল তথ্য উপস্থাপন করে সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে আইনি বৈধতা প্রাপ্তির ব্যবস্থা করে। এভাবেই ‘তিন পাত্তি গোল্ড’ যাত্রা শুরু করে শহর নগরে ছড়িয়ে পড়ে। উল্কা গেমসের যাত্রা গেমিং ডেভেলপমেন্টের উদ্দেশ্যে শুরু হলেও তারা বস্তুত গেম ডেভেলপমেন্ট না করে ‘তিন পাত্তি গোল্ডসহ বিভিন্ন অনলাইন জুয়ার মাধ্যমে বিপুল অর্থ দেশের বাইরে পাঠাচ্ছিল।
তিন পাত্তি গেমস কি?
‘তিন পাত্তি গোল্ড’ মূলত একটি অ্যাপ যা মোবাইলে ডাউনলোড করে খেলা যায়। এ অ্যাপের সার্বিক নিয়ন্ত্রণ মুনফ্রগ ল্যাবের কাছে রয়েছে। এই অ্যাপে ‘তিন পাত্তি গোল্ড’ ছাড়াও রাখি, আন্দর বাহার ও পোকার নামেও অনলাইন জুয়ার গেমস রয়েছে। যেকোনো কাজের পাশাপাশি এই গেমস খেলতে পারা যাওয়ায় তরুণসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছে জনপ্রিয়তা পায়। গেমসের রেজিস্ট্রেশনের পর একজন গ্রাহককে গেমস খেলার জন্য কিছু চিপস ফ্রি দেওয়া হয়। পরে গেমস খেলার জন্য অর্থের বিনিময়ে চিপস কিনতে হয়। মূলত মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে গ্রাহকদের কাছ থেকে চিপস কিনে অর্থের লেনদেন হয়। প্রতিদিন প্রায় ৫০ হfজার কোটি চিপস বিক্রি হয় এবং প্রতি কোটি চিপস বিভিন্ন পর্যায়ে ৪৬ থেকে ৬৫ টাকায় বিক্রি করা হয়। বিভিন্ন বট প্লেয়ার/রোবট প্লেয়ারের মাধ্যমে মূল গেইমারদের কৌশলে হারিয়ে প্লেয়ারদের পরবর্তীতে আরও চিপস কিনতে উৎসাহিত করা হয়। দেশে ‘তিন পাত্তি গোল্ড’ এর চিপস বিক্রির কাজটি ১৪টি অফিসিয়াল ডিস্ট্রিবিউটর/এজেন্টের মাধ্যমে পরিচালনা করা হচ্ছিল। এসব ডিস্ট্রিবিউটরদের সাব-ডিস্ট্রিবিউটর রয়েছে বলে জানা গেছে। এছাড়া প্রাইভেট টেবিল অপশনের মাধ্যমে অন্য প্লেয়ার কাছ থেকেও চিপস ক্রয় করা যেত। বর্তমানে ‘তিন পাত্তি গোল্ড’ এ প্রায় ৯ লাখ নিয়মিত গেইমার রয়েছে এবং প্রতিদিন প্রায় ৩০ লাখ টাকার চিপস বিক্রি হয় বলে জানা যায়।
কে এই জামিল?
জামিলুর রশিদ ঢাকার একটি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশ থেকে ২০১২ সালে অর্থনীতিতে স্নাতক শেষ করে দেশে আসেন। ছোট থেকেই মোবাইল গেমসের প্রতি আসক্ত হওয়ায় ২০১৫ সালে নিজেই মোবাইল গেমস তৈরি শুরু করে। ‘হিরোজ অফ ৭১’ ও ‘মুক্তি ক্যাম্প’ নামে ২০১৭ সালে দুইটি গেমস নির্মাণের জন্য সরকারের কাছ থেকে ৩০ লাখ টাকা অনুদান পায়। পরবর্তীতে ২০১৭ সালে মুনফ্রগ ল্যাবের সঙ্গে পরিচয় হয়। ২০১৮ সালে গেমস ডিজাইন কনসালটেন্ট ও বাংলাদেশে নিযুক্ত কর্মকর্তা হিসেবে মুনফ্রগ হতে দেড় লক্ষাধিক টাকা বেতনে যুক্ত হয়। এরপর ২০১৯ সালে উল্কা গেমস প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সিইও হিসেবে নিযুক্ত হয়ে সে মুনফ্রগ হতে মাসিক প্রায় ৪ লাখ টাকা বেতন পেতেন। এছাড়া সে বাৎসরিক আয়ের ৯০ থেকে ১০০ শতাংশ বোনাস পেত বলে জানা যায়। তার বিভিন্ন অ্যাকাউন্টে বেশ কিছু টাকা, একটি দামি গাড়ি এবং ঢাকা ও ঢাকার বাইরে ফ্ল্যাট ও জমি রয়েছে বলে জানা যায়।
Discussion about this post