রাজধানীতে বিভিন্ন এলাকায় তিন থেকে চার ঘণ্টাও বিদ্যুৎ থাকছে না। ঢাকার বাইরে পরিস্থিতি আরও খারাপ।
অক্টোবর থেকে লোডশেডিং পুরোপুরি কমবে বলে জানিয়েছিল সরকার। উল্টো এ সময়ে এসে বেড়ে গেছে লোডশেডিং। জ্বালানির অভাবে চাহিদামতো বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না। পড়ে থাকছে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা। আর ঘরে ও শিল্পে মানুষ ভুগছেন বিদ্যুতের অভাবে।
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্র বলছে, ‘‘গত জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দিনে সর্বোচ্চ ২ হাজার থেকে ২ হাজার ২০০ মেগাওয়াট পর্যন্ত লোডশেডিং করা হয়েছে। এখন তা বেড়ে হয়েছে আড়াই হাজার থেকে ৩ হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত, যা গত তিন মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় তিন থেকে চার ঘণ্টাও বিদ্যুৎ থাকছে না এখন। আর ঢাকার বাইরে কোনো কোনো এলাকায় ৭ থেকে ১৫ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকছে না। ময়মনসিংহ বিভাগে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) আওতাধীন এলাকায় দিনের অধিকাংশ সময় বিদ্যুৎ থাকছে না।’’
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ‘‘দাম বেড়ে যাওয়ায় তরলীকৃত গ্যাস (এলএনজি) আমদানি কমানো হয়েছে। গ্যাসচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন কমেছে। বিল বকেয়া বাড়তে থাকায় তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকেও চাহিদামতো উৎপাদন করা যাচ্ছে না। আগাম শীতে বিদ্যুতের চাহিদা কমার ভরসায় ছিল সরকার। গরম না কমায় সেটিও কাজে আসেনি। তাই অক্টোবরে লোডশেডিং বন্ধ করার পুরোনো সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে সরকার।’’
ডলার–সংকট জ্বালানি খাতকে কঠিন করে তুলেছে। এক মাস পর হয়তো স্বস্তি পাওয়া যেতে পারে। তবে আগামী গ্রীষ্মে (মার্চ-এপ্রিল) পরিস্থিতি কী হবে, ভাবা যাচ্ছে না।
এর আগে ডলার–সংকটে পড়ে জ্বালানি সাশ্রয়ের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। গত ১৯ জুলাই থেকে শুরু হয় পরিকল্পিত লোডশেডিং। যদিও জুলাইয়ের শুরু থেকেই লোডশেডিং ছিল। দিনে এক ঘণ্টা লোডশেডিংয়ের কথা বলা হলেও তা মানা হয়নি। রাজধানীতে গড়ে দুই ঘণ্টার বেশি লোডশেডিং হয়েছে। আর ঢাকার বাইরে কোথাও কোথাও লোডশেডিং ছিল আট ঘণ্টা পর্যন্ত। সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে ঢাকায় কিছুটা কমলেও অক্টোবরে আগের চেয়ে বেড়ে গেছে লোডশেডিং।
চালু থাকছে লোডশেডিং
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) সূত্র বলছে, ‘‘ভারত থেকে আমদানির বাইরে দেশে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ১৯ হাজার ৫৩৭ মেগাওয়াট। দিনে বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে সাড়ে ৯ হাজার থেকে সাড়ে ১২ হাজার মেগাওয়াট। আর এখন চাহিদা আছে ১২ হাজার থেকে সাড়ে ১৪ হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত। বিদ্যুতের অভাবে উৎপাদন সক্ষমতার ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ কাজে লাগাতে পারছে না শিল্পকারখানা।’’
বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, ‘‘শিল্পে কিছুটা বাড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন খাতে গ্যাসের সরবরাহ কমানো হয়েছে। বিদ্যুৎ খাতের ভর্তুকি হিসেবে পাওয়া টাকা নিয়মিত ছাড় করছে না অর্থ মন্ত্রণালয়। জ্বালানি আমদানি করতে ডলারও পাওয়া যাচ্ছে না নিয়মিত। জ্বালানি তেলচালিত বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকেও সক্ষমতা অনুসারে বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে না।’’
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, ‘‘বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র কয়েক মাস ধরে বিল পাচ্ছে না। জ্বালানি তেলের দামও কমছে না বিশ্ববাজারে। ডলার সাশ্রয়ের কারণে এলএনজি আমদানি করা যাচ্ছে না। এতে করে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো যাচ্ছে না। তাই লোডশেডিং বন্ধ করা যায়নি। এটি আরও কিছুদিন চালু রাখতে হবে।’’
কমেছে গ্যাসের সরবরাহ
এলএনজি আমদানি কমায় গ্যাসের সরবরাহ কমেছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ তেল–গ্যাস, খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা)। দিনে ৩৮০ কোটি ঘনফুট চাহিদার বিপরীতে এখন সরবরাহ করা হচ্ছে ২৬৭ কোটি ঘনফুট। গত মাসেও সরবরাহ ছিল ২৮০ থেকে ২৮৫ কোটি ঘনফুট। এর মধ্যে এলএনজি থেকে এখন সরবরাহ করা হচ্ছে মাত্র ৩৮ কোটি ঘনফুট।
ডলারের দাম নিয়মিত বাড়ছে। এর মধ্যে চার মাস পর বিল দিচ্ছে পিডিবি। এ সময়ে ডলারে বিনিময় হারে পার্থক্য অনেক। লোকসান বেড়ে যাচ্ছে। অনেকে তাই তেল আমদানি করতে পারছে না। এ নিয়ে পিডিবির সুপারিশ মানলেই বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়বে এবং লোডশেডিং পরিস্থিতি থেকে বের হওয়া সম্ভব হবে।
তবে গত জুনে গ্যাসের দাম বাড়ানোর সময় দিনে ৮৫ কোটি ঘনফুট সরবরাহের কথা ছিল পেট্রোবাংলা। এর মধ্যে ছিল দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় ওমান ও কাতার থেকে আনা ৫০ কোটি ঘনফুট এলএনজি। এ দুই দেশ থেকে প্রতি মাসে পাঁচটি করে এলএনজির জাহাজ আসছিল গত জুন থেকে। চুক্তি অনুসারে, অক্টোবরে আসবে মোট চারটি জাহাজ। আর ডলার–সংকটের কারণে খোলাবাজারে (স্পট মার্কেট) এলএনজি কেনা বন্ধ রয়েছে গত জুলাই থেকে। তবে বিশ্ববাজারে এলএনজির দাম কমছে। আগস্টে এটি ৬০ ডলারের কাছাকাছি গেলেও এখন ২৫ ডলারে নেমে এসেছে।
বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রে কম উৎপাদন
বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর বেশির ভাগই নিজেরা ফার্নেস তেল আমদানি করে চালায়। বাড়তি দামে ডলার কিনে জ্বালানি তেল আমদানি করতে হচ্ছে তাদের। এতে করে লোকসান হচ্ছে তাদের। ডলারের প্রকৃত মূল্য ধরে বিল হিসাব করার দাবি জানিয়েছিল তারা। পিডিবি তাদের দাবির পক্ষে সুপারিশও করেছিল। কিন্তু তা অনুমোদন করেনি অর্থ মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া বিদ্যুৎ বিক্রি করে পিডিবি থেকে নিয়মিত বিল পাচ্ছে না তারা। বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিল বকেয়া ১৬ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এ কারণে অনেকেই তেল আমদানি না করে বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রেখেছে।
বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎকেন্দ্র মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসারস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ইমরান করিম বলেন, ‘‘ডলারের দাম নিয়মিত বাড়ছে। এর মধ্যে চার মাস পর বিল দিচ্ছে পিডিবি। এ সময়ে ডলারে বিনিময় হারে পার্থক্য অনেক। লোকসান বেড়ে যাচ্ছে। অনেকে তাই তেল আমদানি করতে পারছে না। এ নিয়ে পিডিবির সুপারিশ মানলেই বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়বে এবং লোডশেডিং পরিস্থিতি থেকে বের হওয়া সম্ভব হবে।’’
পড়ে আছে অলস বিদ্যুৎকেন্দ্র
পিডিবির তথ্য বলছে, দেশে এখন মোট বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা ১৩৩। এর মধ্যে গ্যাসচালিত ৫৭টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মোট উৎপাদন ক্ষমতা ১১ হাজার ১৭ মেগাওয়াট। উৎপাদন হচ্ছে মাত্র ৫ হাজার মেগাওয়াট। অর্ধেকের বেশি উৎপাদন ক্ষমতা অলস পড়ে থাকছে গ্যাসের অভাবে। ফার্নেস তেলচালিত ৫৬টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতা ৫ হাজার ৫৪১ মেগাওয়াট এবং ১১টি ডিজেল কেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতা ১ হাজার ৫১৫ মেগাওয়াট। সব মিলে জ্বালানি তেল থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ৭ হাজার মেগাওয়াটের বেশি হলেও দিনে গড়ে উৎপাদন হচ্ছে আড়াই থেকে ৪ হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত।
উৎপাদন না করলেও চুক্তি অনুসারে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভাড়া (ক্যাপাসিটি চার্জ) দিতে হচ্ছে। এতেও সরকারের হাজার হাজার কোটি টাকা লোকসান হচ্ছে প্রতিবছর। গত তিন বছরেই সরকার কেন্দ্র ভাড়া দিয়েছে ৫৬ হাজার কোটি টাকার বেশি।
লোডশেডিং কমার বদলে উল্টো বেড়েছে বলে জানিয়েছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার জ্বালানিবিষয়ক বিশেষ সহকারী ম. তামিম। তিনি বলেন, ‘‘মূল সমস্যা হলো আর্থিক। ডলার–সংকট জ্বালানি খাতকে কঠিন করে তুলেছে। বেসরকারি খাতের বিল বকেয়াও বাড়ছে। শীত না নামলে কোনোভাবেই লোডশেডিং কমবে না। এক মাস পর হয়তো স্বস্তি পাওয়া যেতে পারে। তবে আগামী গ্রীষ্মে (মার্চ-এপ্রিল) পরিস্থিতি কী হবে, ভাবা যাচ্ছে না।’’