চট্টগ্রাম বন্দর থেকে খালাস হওয়া পাঁচটি মদভর্তি কন্টেইনার ধরা পড়েছে গত তিনদিনে। এর মধ্যে শনিবার (২৩ জুলাই) ভোরে দুটি কন্টেইনার আটক হওয়ার পর মদের চালানের রহস্যের জট খুলতে থাকে। এরপর রোববার ধরা পড়ে আরও দুটি কন্টেইনার। এসব কন্টেইনারে প্রায় ৮৫ হাজার লিটার মদ ছিল। এতে প্রায় ৮০ কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করা হয় বলে জানা গেছে।
এত মদের চালান একসঙ্গে ধরা পড়ায় বিষয়টি এখন ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’-তে পরিণত হয়েছে। সেই সঙ্গে সৃষ্টি হয়েছে ব্যাপক চাঞ্চল্যের। জালিয়াতির মাধ্যমে আরও কন্টেইনার ভর্তি মদ পাচার হয়েছে বলে ধারণা করছে চট্টগ্রাম বন্দর ও কাস্টমস সংশ্লিষ্টরা।
চট্টগ্রাম বন্দরে ধরা পড়া এই পাঁচ কন্টেইনার মদের চালান খালাসের ছক তৈরি হয় নগরীর কাজির দেউরির একটি কম্পিউটারের দোকানে। এক কাস্টমস কর্মকর্তার অফিসিয়াল সিস্টেম আইডি হ্যাক করে তৈরি করা হয় জাল আইপি । এরপর তৈরি করা হয় জাল কাগজপত্র। আর এ কাজ করেন জাফর আহমেদ নামের এক সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট। কন্টেইনার বন্দর থেকে বের করার দায়িত্ব ছিল তার কাঁধে। তবে মদভর্তি কন্টেইনারের গন্তব্য ছিল ঢাকার মুন্সিগঞ্জের আজিজুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তির কাছে। এসব কন্টেইনার খালাস থেকে শুরু করে গন্তব্যে পৌঁছানো পর্যন্ত দুবাই থেকে সবকিছুর তদারকি করেন নাসির উদ্দীন নামের এক ব্যক্তি। তবে তার বাড়িও মুন্সিগঞ্জে।
জানা গেছে, নগরীর ডবলমুরিং থানার গোসাইলডাঙ্গার ৬৯৯, কে বি দোভাষ লেইনের ‘জাফর আহমেদ’ নামের সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের স্বত্বাধিকারী জাফর আহমেদ, শামীম ও রায়হানের ওপর দায়িত্ব ছিল এসব কন্টেইনার খালাস করার। এরপর এসব মদভর্তি কন্টেইনার পৌঁছে দেওয়ার কথা ছিল ঢাকার মুন্সিগঞ্জের একটি চক্রের হাতে। এজন্য তারা কাস্টমস ও বন্দরের বিভিন্ন জাল কাগজপত্রও তৈরি করে।
মূলত এসব কন্টেইনার করে গার্মেন্টস পণ্য আনার ঘোষণা দেওয়া হয়। এরমধ্যে ঈশ্বরদী ইপিজেডের বিএইচকে টেক্সটাইল মিলস লিমিটেড একটি, কুমিল্লা ইপিজেডের হাসি টাইগার কোম্পানি লিমিটেড একটি, নীলফামারী উত্তরা ইপিজেডের ডং জিন ইন্ডাস্ট্রিয়াল (বিডি) কোম্পানি লিমিটেড ২টি এবং বাগেরহাটের মংলা ইপিজেডের ভিআইপি ইন্ডাস্ট্রিজ বাংলাদেশ প্রাইভেট লিমিটেডের নামে একটি চালানে গার্মেন্টস পণ্যের বদলে চীন থেকে আনা হয় মদভর্তি এসব বোতল। আর সবকিছুর পেছনে মুন্সিগঞ্জের ওই চক্র। যেটি মূলত নিয়ন্ত্রণ হয় দুবাই থেকে।
তবে র্যাব জানান, ঈশ্বরদী ও কুমিল্লা ইপিজেডে এ দুটি প্রতিষ্ঠানের কোনো অস্তিত্ব নেই। অপরদিকে নিলফামারী ও বাগেরহাটের ওই দুটি প্রতিষ্ঠানেরও অস্তিত্ব নেই। এ প্রতিষ্ঠানগুলোর নামে ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে বিপুল পরিমাণ মদ আমদানির পেছনের মূল ব্যক্তি হলেন আজিজুল ইসলাম। বন্দর থেকে বের হওয়া মদের চালানটি তার কাছেই যাওয়ার কথা ছিল।
ঘটনার এ বিষয়ে কাস্টমস কমিশনার মো. ফখরুল আলম বলেন, ‘কাস্টমস আইন ও ফৌজদারি আইনে বিচার হবে জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত চক্রের। কাস্টমসের বিশেষায়িত সফটওয়্যার অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেমে এতো কঠোরতা সত্ত্বেও পাসওয়ার্ড চুরির মাধ্যমে চোরচক্র আইপি নিয়ে সব ধরনের জালিয়াতি করেছে। তাদের ছাড় দেওয়া হবে না।’
যেভাবে বের হলো কন্টেইনার :
কীভাবে বন্দর থেকে বের হলো কন্টেইনারগুলো—এর খোঁজ নিতে গিয়ে বের হয়ে আসে জালিয়াতির তথ্য। মূলত ভুয়া আমদানিকারক সেজে কাস্টমস কর্মকর্তার আইডি হ্যাক করে ভুয়া আমদানির অনুমতিপত্র (আইপি) ব্যবহার করে প্রতারক চক্র। এ কাজে চট্টগ্রাম কাস্টমসের ইপিজেড শাখার রাজস্ব কর্মকর্তা (আরও) নাছির উদ্দিনের আইডি ব্যবহার করা হয়।
শুধু আইপি নয়, শুরুতে দুটি কন্টেইনার কাস্টমসের আনস্টাফিং, স্ক্যানিং ও গেট ডিভিশনকে জাল কাগজ দেখিয়ে ফাঁকি দিয়ে কাভার্ডভ্যানে করে বের করা হয় বন্দর থেকে। বন্দরের এক গেটে স্ক্যানিং হয়েছে বলে কাগজ দেখিয়ে ১ নম্বর গেট দিয়ে বের হয় কন্টেইনার দুটি। যা নারায়ণগঞ্জে আটক করে র্যাব।
আড়ালে যারা :
মদের চালানের মূলহোতা মুন্সিগঞ্জের আজিজুল ইসলাম, তার বড় ছেলে মিজানুর রহমান আশিক ও ছোট ছেলে আহাদ। আজিজুলের ছোট ছেলে আহাদকে রোববার সকালে বিমানবন্দর এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। শনিবার দুবাই পালিয়েছেন আজিজুল ও তার বড় ছেলে আশিক। তবে দুবাই বসে চক্রের কলকাঠি নাড়ছেন নাসির উদ্দিন নামের এক ব্যক্তি। তার বাড়িও মুন্সিগঞ্জে।
আজিজুলের বাড়ি মুন্সিগঞ্জের ষোলঘর ইউনিয়নে। চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রম ও নিরাপত্তা কার্যক্রম সামলেছেন গ্রেপ্তার হওয়া আহাদ। আহাদ ও তার বড় ভাই আশিক কন্টেইনার মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগরে তাদের নিজস্ব ওয়্যারহাউজে নিচ্ছিলেন। তাদের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে ৯৮ লাখ টাকা, ৪ হাজার ইউরো, ১১ হাজার চীনা ইউয়ানসহ কয়েক কোটি টাকা মূল্যের ভারত, নেপাল, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার মুদ্রা উদ্ধার করা হয়।
চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের যুগ্ম কমিশনার (জেসি) মো. সালাউদ্দিন রেজভী দৈনিক চট্টগ্রামকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম নগরীর কাজির দেউড়ি এলাকার একটি কম্পিউটারের দোকানে বসেই তৈরি হয়েছিল জাল সব কাগজপত্র। আমাদের ধারণা, এ কাজের জন্য সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টকে কন্ট্রাক্ট দেওয়া হয়। তবে এই চক্রটির সব আদ্যপান্ত আমাদের হাতে এসেছে। ইতোমধ্যে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রামের ইপিজেডের রাজস্ব কর্মকর্তা নাছির উদ্দিনের আইপি হ্যাক করে জালিয়াতির সূচনা করে চক্রটি। এছাড়া নগরের কাজির দেউরিতে বসেই মদের চালান খালাসের পরিকল্পনা হয়। চক্রটিকে ধরতে কাজ করে যাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।’