আন্তর্জাতিক বাজারে হু হু করে বাড়ছে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) দাম। জ্বালানিটির দাম ভেঙেছে বিগত আট বছরের রেকর্ড। যে কারণে দেশেও বাড়তি এলপিজি সিলিন্ডারের দাম। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, এপ্রিল মাসে যেখানে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সাড়ে ১২ কেজির এলপিজি সিলিন্ডারের দাম ১ হাজার ৪৯৯ টাকা, সেখানে গ্রাহক পর্যায়ে সরকারি (এলপিজিএলের) এলপিজির দাম ৫৯১ টাকা। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে তাদের বাজারমূল্যের অর্ধেকেরও কম দামে বাল্কে এলপিজি বিক্রি করতে চায় বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি), যা গ্রাহক পর্যায়ে কোনো সুফল বয়ে আনবে না।
মূলত বিপিসির অঙ্গ প্রতিষ্ঠান ইস্টার্ন রিফাইনারিতে এলপিজি উৎপাদন বেড়েছে আগের চেয়ে ৪০ শতাংশ। ইস্টার্ন রিফাইনারিতে উৎপাদিত এলপিজি বোতলজাত করে বিপিসির আরেক অঙ্গ প্রতিষ্ঠান এলপি গ্যাস লিমিটেড (এলপিজিএল)। ইস্টার্ন রিফাইনারির উৎপাদন বাড়লেও এলপিজিএলের বোতলজাত করার সক্ষমতা বাড়েনি। যে কারণে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে বাল্কে এলপিজি বিক্রির উদ্যোগ নেয় এলপিজিএল। কারণ উৎপাদিত এলপিজি নির্ধারিত সময়ে বাজারজাত করা না গেলে ইস্টার্ন রিফাইনারির কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়। ইস্টার্ন রিফাইনারিতে উৎপাদন স্বাভাবিক রাখতে স্টোরেজ পূর্ণ হওয়ার পর উৎপাদিত অতিরিক্ত এলপিজি অনেক সময় পুড়িয়ে ফেলতে হয়। এই এলপিজি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রির উদ্যোগ নিতে গিয়ে কম দাম প্রস্তাব করায় নতুন করে সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।
বর্তমানে বেসরকারি পর্যায়ে সাড়ে ১২ কেজির এলপিজির দাম ১ হাজার ৪৯৯ টাকা। বাল্কে বিক্রির জন্য একই পরিমাণ গ্যাসের মূল্য দেখানো হয় ৬৯০ টাকা ২৭ পয়সা।
জানা যায়, এলপিজি তৈরির মূল উপাদান প্রোপেন ও বিউটেন আমদানি করে বেসরকারি এলপিজি প্ল্যান্টগুলো। পেট্রোলিয়াম গ্যাসের এ দুই উপাদানের মূল্য সৌদি আরবের প্রতিষ্ঠান আরামকো সিপি (কার্গো প্রাইস) অনুসারে নির্ধারিত হয়। সৌদি সিপিকে ভিত্তিমূল্য ধরে দেশে প্রতি মাসে এলপিজির দাম সমন্বয় করে বিইআরসি। সৌদি সিপি অনুসারে এপ্রিলে প্রোপেন ৯৪০ ডলার ও বিউটেন ৯৬০ ডলার ধরে ৩৫:৬৫ অনুপাতে মিশ্রণ বিবেচনায় গত ৩ এপ্রিল বিইআরসি এপ্রিল মাসের জন্য এলপিজির মূল্য সমন্বয় করে। ওই মূল্য সমন্বয় আদেশে এপ্রিল মাসে প্রতি মেট্রিক টন এলপিজির সৌদি সিপি অনুযায়ী মূল্য নির্ধারণ করা হয় ৯৫৩ ডলার।
বেসরকারি এলপিজি প্রতিষ্ঠানগুলোর হিসাব মতে, বেসরকারিভাবে এলপিজি আমদানিতে প্রতি টনে গড়ে ১০০ ডলার করে জাহাজ ভাড়া খরচ হয়। সে অনুযায়ী জাহাজ ভাড়াসহ (পরিবহন খরচ, বোতলজাত খরচ, ব্যাংক চার্জ, অগ্রিম কর, অগ্রিম আয়কর, ভ্যাট ও অন্য ব্যয় বাদে) প্রতি টন এলপিজির মূল্য দাঁড়ায় এক হাজার ৫৩ ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় (প্রতি ডলার ৮৬ টাকা ২৫ পয়সা ধরে) ৯০ হাজার ৮২১ টাকা। এতে আমদানিমূল্য ও শুধু জাহাজভাড়া মিলে প্রতি কেজি এলপিজির দাম পড়ে ৯০ টাকা ৮২ পয়সা। সেই হিসাবে সাড়ে ১২ কেজি এলপিজির মূল্য হয় অন্তত এক হাজার ১৩৫ টাকা।
তবে গত ৭ এপ্রিল বিপিসির চেয়ারম্যান এবিএম আজাদ স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে বাল্ক আকারে এলপিজি বিক্রির অনুমোদন চেয়ে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগে আবেদন করা হয়। জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিবকে এ সংক্রান্ত চিঠি দেয় বিপিসি। ওই চিঠিতে ২০২০ সালের ১৩ অক্টোবর এলপি গ্যাস লিমিটেড দুই হাজার টন এলপিজি বাল্কে বিক্রির তথ্য উপস্থাপন করা হয়। ওই বিক্রয়াদেশ অনুযায়ী সাড়ে ১২ কেজির এলপিজির বিক্রয় মূল্য প্রস্তাব করা হয়েছে ৬৯০ টাকা ২৭ পয়সা (ভ্যাটসহ)। এছাড়া প্রতি টনের মূল্য ৫৫ হাজার ২২২ টাকা (ভ্যাটসহ) নির্ধারণ করা হয়।
বিপিসির অঙ্গ প্রতিষ্ঠান ইস্টার্ন রিফাইনারিতে আগের চেয়ে ৪০ শতাংশ এলপিজি উৎপাদন বেড়েছে। ইস্টার্ন রিফাইনারির উৎপাদন বাড়লেও এলপিজিএলের বোতলজাত করার সক্ষমতা বাড়েনি। যে কারণে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে বাল্কে এলপিজি বিক্রির উদ্যোগ নেয় প্রতিষ্ঠানটি
ওই চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়, বর্তমানে বিইআরসি বিপণন কোম্পানিগুলোর জন্য সাড়ে ১২ কেজি এলপিজি সিলিন্ডারের মূল্য নির্ধারণ করেছে ৫১১ টাকা (ভ্যাটসহ)। এছাড়া প্রতি টনের মূল্য ৪০ হাজার ৮৮০ টাকা উল্লেখ করা হয়। এতে ওই সময়ে বাল্কে এলপিজি বিক্রি করে এলপি গ্যাস লিমিটেড প্রতি টনে ১৪ হাজার ৩৪২ টাকা করে মুনাফা করেছে বলে উল্লেখ করা হয় চিঠিতে। অথচ ২০২০ সালের অক্টোবর মাসে এলপিজির সৌদি সিপি ছিল বর্তমান মূল্যের মাত্র ৪০ শতাংশ। তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের অক্টোবর মাসে সৌদি সিপি অনুযায়ী প্রতি টন এলপিজির মূল্য ছিল ৩৭৮ দশমিক ২৫ ডলার (প্রোপেন ৩৭৫ ডলার ও বিউটেন ৩৮০ ডলার)। বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে এলপিজির দাম কয়েকগুণ বাড়লেও আগের কম দামে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে বাল্কে এলপিজি বিক্রির অনুমোদন চাওয়া নিয়ে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে।
এলপি গ্যাস পরিবেশক সমিতি চট্টগ্রামের যুগ্ম সম্পাদক ও এলপিজি আমদানিকারক ব্যবসায়ী মো. শামীম চৌধুরী বলেন, এলপিজিএল সরকারি প্রতিষ্ঠান। ইস্টার্ন রিফাইনারি থেকে উৎপাদিত এলপি গ্যাস সরকারিভাবে বাজারজাত না করে বেসরকারি পর্যায়ে বাল্কে বিক্রি খুবই দুঃখজনক। এর মাধ্যমে ভোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এলপিজিএলের উচিত তাদের বাজার সম্প্রসারণের ব্যবস্থা করা, নিজেদের বোতলজাত সক্ষমতা বাড়ানো। এর মাধ্যমে সরকার ও ভোক্তা উভয়ই লাভবান হবে।
তিনি বলেন, কোনো কারণে যদি বাল্কে এলপিজি বিক্রি করতে হয়, তাহলে উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে করা উচিত। শুধু সৌদি সিপি অনুযায়ী দাম ধরলেও বর্তমান বাজারে সাড়ে ১২ কেজি এলপিজি এক হাজার টাকার বেশি বিক্রি হবে।সরকারি গ্যাস বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো কম দামে কিনে আবার সেই গ্যাস বেশি দামে ভোক্তাদের কাছে বিক্রি করবে। এখানে সরকারি অর্থেরও অপচয় হবে, ভোক্তাদের কোনো উপকার হবে না। মধ্যস্বত্বভোগীরাই এর সুযোগ নেবে
ব্যবসায়ী মো. শামীম চৌধুরী আরও বলেন, বেসরকারি পর্যায়ে সৌদি সিপি অনুযায়ী এলপিজি আমদানি করতে প্রতি টনে গড়ে ১০০ ডলার জাহাজ ভাড়া, ৩ শতাংশ অগ্রিম কর (এটি), ২ শতাংশ অগ্রিম আয়কর (এআইটি), ১ শতাংশ ব্যাংক চার্জ, ১ শতাংশ বন্দর ও সিঅ্যান্ডএফ খরচ ধরতে হবে। এর সঙ্গে ৭ শতাংশ ভ্যাট এবং অপারেশনাল চার্জ যোগ করে নির্ধারণ করতে হবে বিক্রয়মূল্য।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রাম জেলার সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আখতার কবীর চৌধুরী বলেন, রাষ্ট্র এখন ব্যবসায়ীবান্ধব হয়ে উঠছে। এখানে মধ্যস্বত্বভোগীদের সুরক্ষা দেওয়া হচ্ছে। বেসরকারি পর্যায়ে যে গ্যাস এক হাজার ৫শ টাকা, সেই পরিমাণ গ্যাস ৬৯০ টাকায় বিক্রির প্রস্তাব করা মানেই এখানে অনিয়ম করার দুরভিসন্ধি রয়েছে। এখানে আন্ডারহ্যান্ড ডিলিংয়ের সুযোগ তৈরি হবে। কারণ সরকারি গ্যাস বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো কম দামে কিনে আবার সেই গ্যাস বেশি দামে ভোক্তাদের কাছে বিক্রি করবে। এখানে সরকারি অর্থেরও অপচয় হবে, ভোক্তাদের কোনো উপকার হবে না।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে এলপি গ্যাস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবু হানিফ বলেন, ইস্টার্ন রিফাইনারি থেকে বর্তমানে যে পরিমাণ এলপিজি দেওয়া হচ্ছে, স্বাভাবিকভাবে এত পরিমাণ এলপিজি বোতলজাত করে সরবরাহ করার মতো সক্ষমতা আমাদের নেই। এখন আমরা ওভারটাইম দিয়ে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত বোতলজাত করার কার্যক্রম চালিয়ে আসছি। তারপরেও অতিরিক্ত এলপিজি রয়ে যাচ্ছে। বাল্কে যদি বিক্রি করা না হয়, তাহলে ইস্টার্ন রিফাইনারির পুরো কার্যক্রম ব্যাহত হবে। বাল্কে যখন বিক্রি হবে উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমেই হবে।
তবে কম দাম উল্লেখ করে মন্ত্রণালয়ে অনুমোদন চাওয়ার বিষয়টি জানা নেই বলে তিনি জানান।
Discussion about this post