‘যে মাটিকে আমি এতো ভালোবাসি, যে মানুষকে আমি এতো ভালোবাসি, যে জাতিকে আমি এতো ভালোবাসি, আমি জানতাম না সে বাংলায় আমি যেতে পারবো কি-না। আজ আমি বাংলায় ফিরে এসেছি বাংলার ভাইদের কাছে, মায়েদের কাছে, বোনদের কাছে। বাংলা আমার স্বাধীন, বাংলাদেশ আজ স্বাধীন।’
-বঙ্গবন্ধু, ১০ জানুয়ারি, ১৯৭২
দিনটি ছিল সোমবার। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দাঁড়িয়ে জনগণনন্দিত শেখ মুজিব তার ঐতিহাসিক ধ্রুপদি বক্তৃতায় এই কথার মাধ্যমে বাংলার প্রতি, বাংলার মানুষের প্রতি তাঁর চিরায়ত অকৃত্রিম হৃদ্যতার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন। পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী এক যুদ্ধে বিজয়ের পর ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন সদ্য স্বাধীন বাঙালি জাতির কাছে ছিল একটি বড় অনুপ্রেরণা। দীর্ঘকালের সংগ্রাম, অপরিমেয় ত্যাগ-তিতিক্ষা, আপোষহীন আন্দোলন ও সর্ব্বোচ্চ আত্মত্যাগের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে বির্জয় অর্জনের পর বিধ্বস্ত বাংলাদেশকে সামনে এগিয়ে নেয়ার প্রশ্নে বাঙালি জাতি যখন কঠিন এক বাস্তবতার মুখোমুখি, তখন পাকিস্তানের বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
১০! সংখ্যাটি যেভাবে আমাদের হলোঃ
এই বাংলার বহমান সমাজ ও লোকাচারে আদিকাল থেকেই বিভিন্ন প্রবাদে দশ সংখ্যাটি বেশ গুরুত্ব পেয়ে আসছিলো। তবে এই সমস্ত কথার ভাবার্থ কিংবা ভাবসম্প্রসারণ থেকে বেরিয়ে আসে অনুপ্রেরণা ও নতুন ভাবনা। যেমন ধরুন- ‘দশচক্রে ভগবান ভূত’, ‘দশে মিলে করি কাজ হারি জিতি নাহি লাজ’, ‘দশের লাঠি একের বোঝা’, ‘চোরের দশ দিন তো গৃহস্থের একদিন’, ‘সময়ের এক ফোঁড় অসময়ের দশ ফোঁড়’, ইত্যাদি। বাঙালিদের মধ্যে দশ সংখ্যাকে সর্বশেষ যিনি ভীষণভাবে স্পর্শ করেছিলেন তিনি আর কেউ নন, তিনি স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলার রূপকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ২৮৯ দিন বন্দি থাকার পর পাকিস্তানের মিয়ানওয়ালি কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে এই দিনে তিনি ঢাকায় ফিরে আসেন। সেই থেকে অতীতের সব প্রবাদের হাত ধরে বাংলাদেশের মানুষ পেয়ে যায় একটি কিংবদন্তী ১০ এর দেখা। সেই থেকে বাঙ্গালির ইতিহাসে এই দিনটি এক বিশেষ স্থান দখল করে আছে।
কেমন ছিল ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দিনটি বা তার আগের কয়েকটি দিন?
ডেটলাইন ৮ জানুয়ারি
পাকিস্তানের পিআইএ’র একটি বিশেষ বিমান রাওয়ালপিন্ডি থেকে উড্ডয়নের সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানের নতুন প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘দ্য নাইটিঙ্গেল হ্যাজ ফ্লোউন।’
ডেটলাইন ৯ জানুয়ারি
টাইম ম্যাগাজিন ২৪ জানুয়ারি ১৯৭২-এ লিখেছে, লন্ডনে বঙ্গবন্ধু উঠেছেন ক্লারিজ হোটেলে। প্রেসিডেন্ট মর্যাদায় একটি সুইটে রাখা হয়েছে তাঁকে। সারা দিনটাই তিনি বিশ্রাম নিলেন। দেখা করলেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হিথের সঙ্গে। বিকেলে একটি প্রেস কনফারেন্স করলেন।
ডেটলাইন ১০ জানুয়ারি
বঙ্গবন্ধুকে নেওয়ার জন্য একটি ভারতীয় ৭০৭ বোয়িং বিমান প্রস্তুত ছিল হিথরো বিমানবন্দরে। তিনি ভারতীয় বিমানে উঠলেন না। টাইম ম্যাগাজিন লিখেছে, দুটি কারণে তিনি ভারতীয় বিমান এড়িয়ে গেলেন। প্রথমত, ভারতীয় বিমানে উন্মাদ পাকিস্তানিদের নাশকতার আশঙ্কা ছিল। দ্বিতীয়ত, শেখ মুজিব সবাইকে বোঝাতে চাইলেন, বাংলাদেশ একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ। ভারতের ওপর তারা নির্ভরশীল হতে চায় না। স্বদেশে ফেরার জন্য বঙ্গবন্ধু উঠে পড়লেন ব্রিটিশ রাজকীয় বিমানবহরের কমেট জেটে। বাংলাদেশে ফেরার পথে বিমানটি দুই ঘণ্টার সংক্ষিপ্ত যাত্রাবিরতি করেছিল দিল্লিতে। সেখানে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি ও প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন।
টাইম ম্যাগাজিন লিখেছে, ৯ জানুয়ারি দিনটি ছিল রবিবার। বাংলাদেশের সাপ্তাহিক ছুটির মধ্যে সারা দেশ আনন্দ-উল্লাসে উত্তাল। অধীর আগ্রহে সবাই অপেক্ষা করছে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের। বিধ্বস্ত যোগাযোগব্যবস্থার মধ্যেও লোকজন ছুটতে শুরু করেছে ঢাকার দিকে। ১০ জানুয়ারি বদলে গেছে বাংলাদেশ।
তোমারে বধিবে যে, গোকুলে বাড়িছে সেঃ
রণাঙ্গনে যে স্লোগানটি সবচেয়ে বেশি ধ্বনিত হতো, যে স্লোগানটি সবচেয়ে বেশি অনুপ্রেরণা দিত সেটি ছিল ‘জয় বাংলা।’ কিন্তু এটি এখন সর্বজনবিদিত যে, মুক্তিযুদ্ধের সময় ‘জয় বাংলা’র পরে যে শ্লোগানটি সকলের বুকে শক্তি জোগাত সেটি ছিল, ‘তোমার নেতা আমার নেতা শেখ মুজিব, শেখ মুজিব।’
পাকিস্তানের ২৩ বছরের অনৈতিক শাসন-শোষণের সর্বশেষ পরিণতি বাঙালির মহান মুক্তিযুদ্ধ। ১৯৭১ এর ২৫ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দিলে অকুতোভয় বাঙালি ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে বাঙালি নিধনের এই যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগ মুহূর্তে বঙ্গবন্ধুকে তাঁর ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের বাড়ি থেকে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী অত্যন্ত অমর্যাদাকরভাবে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় পাঞ্জাবের মিয়ানওয়ালি কারাগারে। তাঁর বিরুদ্ধে উত্থাপন করা হয় ১২টি অভিযোগ, যার মধ্যে একটি ছিলো রাষ্ট্রদ্রোহ এবং সেসময় পাকিস্তানের আইনে রাষ্ট্রদ্রোহের একমাত্র শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড। প্রহসনের বিচারে বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসির আদেশও দেয়া হয়। কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক সরকার সেটি কার্যকর করার আগেই বাংলাদেশ বিশ্ব মানচিত্রে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পরপরই পাকিস্তান জুড়ে তীব্র গণআন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ইয়াহিয়া খান এবং ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে আসেন পিপলস পার্টির প্রধান জেড এ ভুট্টো।
জিন্নাহর পাকিস্তানের যে বাস্তব অস্তিত্ব আর নেই সেটি ঠিকই আঁচ করতে পেরেছিলেন জেড এ ভুট্টো। ভুট্টো খণ্ডিত পাকিস্তানের একটি অংশের প্রেসিডেন্ট মাত্র। অবশ্য ভুট্টো জিন্নাহর পাকিস্তানকে রক্ষা করতে শেষ চেষ্টা চালিয়েছিলেন। সেই উদ্দেশ্যকে সফল করতে ভুট্টোর একান্ত ইচ্ছায় বঙ্গবন্ধুকে কারাগার থেকে রাওয়ালপিণ্ডির কাছে একটি রাষ্ট্রীয় অতিথিশালায় নিয়ে আসা হয়। ভুট্টো এলেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে। বঙ্গবন্ধু তখনো ঠিক জানেন না তাঁর প্রিয় বাংলাদেশে কি ঘটে চলেছে। তবে ভুট্টোর কথায় তিনি বুঝে গেলেন বাংলাদেশ স্বাধীন আর ভুট্টো একটি খণ্ডিত পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট। ভুট্টো অনেকটা অনুনয় করে বঙ্গবন্ধুর কাছে অনুরোধ করলেন, তিনি যেন পাকিস্তানের সঙ্গে একটি যোগসূত্র রাখেন। বঙ্গবন্ধু জনমানুষের নেতা। তিনি তাঁর জনগণের সঙ্গে আগে কথা বলতে চান জানিয়ে দিলেন ভুট্টোকে। ভুট্টোর অসহায়ত্ব ঠিকই বুঝে গেছেন বঙ্গবন্ধু। ভুট্টো সত্তরের নির্বাচনের পর ইয়াহিয়ার সঙ্গে সম্মিলিতভাবে যে ষড়যন্ত্র করেছিলেন বঙ্গবন্ধুর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করতে, তিনি আজ নিজেই তার সেই ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে খণ্ডিত পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট।
যদি রাজনীতির কবি না আসতেন!
যদি পাকিস্তানিরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতো তবে কী হতো বা তিনি যদি ওই সময়ে কারাগার থেকে মুক্ত না হতেন? এতো বছর পর সেটির উত্তর দেয়া ভীষণ কঠিন। তবে স্বাধীন বাংলাদেশ সেসময় এক গভীর সংকটে নিমজ্জিত হতো সেটি বলাই যায়। যুদ্ধের সময় কিভাবে সরকার গঠিত হবে তা নিয়ে ছিল ধোঁয়াশা। আওয়ামী লীগের তৎকালীন অনেক নেতাই চেয়েছিলেন বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের নিয়ে একটি জাতীয় সরকার গঠন করতে। আবার সেনাবাহিনীর একটি অংশ চেয়েছিলো তাদের নেতৃত্বে বিপ্লবী কমান্ডো কাউন্সিল গড়ে তুলতে। তবে এটি হলে বিশ্বের কাছে একটি ভুল বার্তা যেতো বলেই মনে হয়। তখন বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম হয়ে যেত কেবলই একটি সেনা বিদ্রোহ। এই দুটির যেকোন একটি ঘটলেই ভারতের সহায়তা পাওয়াও তখন কঠিন হয়ে যেতো।তবে এই সমস্যার বিষয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা অবগত ছিলেন বলেই নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের নিয়ে সরকার গঠন করেছিলেন তাঁরা। কিন্তু চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হবার পরও এই সমস্যাটি থেকে যায়। তখন অনেক মুক্তিযোদ্ধার হাতেই অস্ত্র ছিল। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে ক্ষমতার টানাপোড়নে স্বাধীন দেশে পুনরায় শুরু হতে পারত এক ভ্রাতৃঘাতী গৃহযুদ্ধ। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের কারণে এসবের কিছুই ঘটেনি। তাঁর অসাধারণ সম্মোহনী নেতৃত্বের কাছে মুহূর্তেই সব পরাভূত হয়েছিল। তাঁর ডাকে মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র জমা দিয়ে ফিরে গিয়েছিল স্বাভাবিক জীবনে।
ঐ মহামানব আসে, দিকে দিকে রোমাঞ্চ জাগেঃ
পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করার পূর্বেই ভুট্টো বলেছিলেন তেহরানের কথা কিন্তু বঙ্গবন্ধু এতে রাজি হন নি। ভারত ছাড়া অন্য দেশ বেছে নিতে বললে তিনি লন্ডনের নাম বলেন। ৯ জানুয়ারি সকাল ৮.৩০ মিনিটে হিথ্রো বিমান বন্দরে তিনি পৌঁছান। সেখান থেকে তাঁকে রাষ্ট্রীয় অতিথির মর্যাদা দিয়ে হোটেল ক্লারিজে নিয়ে যাওয়া হয়। স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে বঙ্গবন্ধু জীবনের প্রথম প্রেস কনফারেন্সে যোগ দেন এই হোটেলের বলরুমে বসে। তাঁর সে ধ্রুপদী বক্তৃতায় তিনি বললেন, “আমি আজ মুক্ত অবস্থায় আমার দেশবাসীর সাথে সীমাহীন স্বাধীনতার আনন্দ ভাগ করতে চাই। মুক্তির মহাকাব্যিক সংগ্রাম শেষে আমরা কাংখিত স্বাধীনতা অর্জন করেছি।” তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ বঙ্গবন্ধুর এই আকস্মিক সফরের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। তখন তিনি রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজে লন্ডনের বাইরে অবস্থান করছিলেন। পরবর্তীতে (১৯ জানুয়ারি) এক তারবার্তায় তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে লিখেছিলেন, “শেখ মুজিবকে বহনকারী বিমানটি অবতরণের এক ঘণ্টা আগে আমরা জানতে পারি যে, তাঁকে লন্ডনে নিয়ে আসা হচ্ছে। ব্যাপারটা এতই গোপনীয় ছিল।”
তবে অন্যদিকে বেশ অভূতপূর্ব এক ঘটনা ঘটে গেছে। ব্রিটিশ লেবার পার্টির নেতা যিনি অবশ্য পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন সেই হেরাল্ড উইলসন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে গিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুকে দেখামাত্র তিনি বলেছিলেন, “গুড মর্নিং, মিস্টার প্রেসিডেন্ট।” অথচ তখনও ব্রিটেন বাংলাদেশকে নতুন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। বাস্তবতা হল, শুধু ভারত এবং ভুটান ছাড়া অন্য কোনো রাষ্ট্র বাংলাদেশকে তখনও স্বীকৃতি দিতে এগিয়ে আসেনি। প্রধানমন্ত্রী হিথ তাঁর পূর্ব নির্ধারিত সফর বাদ দিয়ে বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করতে ছুটে আসেন ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে। প্রধানমন্ত্রী হিথ সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধানকে নজিরবিহীন সম্মাননা প্রদান করেন। তিনি তাঁর অফিসের বাইরে এসে গাড়ির দরজা খুলে বঙ্গবন্ধুকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করেন। এমন কাণ্ড সচরাচর আর দেখেনি বিশ্ব।
স্নায়ুযুদ্ধের সেই সময়ে ব্রিটেন পাকিস্তান, আমেরিকাসহ মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে বিরাজমান সম্পর্ক অটুট রেখেও বাংলাদেশের এই মহান নেতাকে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দিতে এতটুকু দ্বিধাবোধ করেনি। এ থেকে এটি পরিষ্কার ধারণা করা যায় যে, বিশ্ব মূলত ভারত অঞ্চলে একজন নতুন নেতার আবির্ভাবের জন্যই অপেক্ষা করছিল। বঙ্গবন্ধুকে ভারতে নিয়ে যাবার জন্য হিথ্রো বিমানবন্দরে এয়ার ইন্ডিয়ার একটি ৭০৭ বিশেষ বিমান অপেক্ষা করছিল, তবে তিনি ব্রিটিশ বিমান বাহিনীর কমেট জেটে করে দেশের পথে রওনা দেন। দিল্লীর প্যারেড গ্রাউন্ডে বঙ্গবন্ধু যখন ইংলিশে তাঁর ভাষণ শুরু করলেন তখন জনতার সারি থেকে দাবি উঠে বাংলায় ভাষণ দেবার জন্য। শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীও তাঁকে সেদিন একই অনুরোধ করেন। প্রাণখোলা হাসিতে বঙ্গবন্ধু বাংলায় বলে উঠলেন, “আমার ভাই ও বোনেরা, আপনাদের প্রধানমন্ত্রী, আপনাদের সরকার, আপনাদের সৈন্যবাহিনী, আপনাদের জনসাধারণ যে সাহায্য ও সহানুভূতি আমার দুঃখী মানুষকে দেখিয়েছে চিরদিন বাংলার মানুষ তা ভুলতে পারবে না। আমাকে প্রশ্ন করা হয় শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে আপনার আদর্শের এত মিল কেন? আমি বলি এটা আদর্শের মিল, এটা নীতির মিল, এটা মনুষ্যত্বের মিল এটা বিশ্বশান্তির মিল।”
অবশেষে কবি এলেনঃ
দিল্লী পর্ব শেষ করে বঙ্গবন্ধু ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হন। সকাল থেকেই তেজগাঁও বিমানবন্দরে হাজার হাজার মানুষ জমায়েত হতে থাকে। রেসকোর্স ময়দান পূর্ণ হয়ে যায় লাখো মানুষে। লক্ষ লক্ষ আকুল জনতার চোখ আকাশ পানে। উত্তাল জনতা। শাসরুদ্ধকর অপেক্ষা। স্বাধীনতার স্বাদে উদ্বেলিত গোটা জাতি। কখন ফিরবেন প্রিয় মানুষ। সেদিন আকাশ ছিল শান্ত-নির্মল। এক টুকরো সাদা মেঘও ছিল না কোথাও। হঠাৎ একটা চিল উড়তে দেখলে জনতা উৎফুল্ল হয়ে উঠছিল এই মনে করে যে, ওটা বুঝি বঙ্গবন্ধুর বিমান। অবশেষে সেই কাঙ্ক্ষিত বিমানটি যখন আকাশে দেখা গেল, উল্লাসে ফেটে পড়লো জনতা। বিমানটি কয়েকবার আকাশে চক্কর দিয়ে অবতরণ করলো রানওয়েতে। লক্ষাধিক লোকের স্রোত ভেঙে তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্স ময়দানে আসতে বঙ্গবন্ধুর সময় লেগে যায় প্রায় দুই ঘণ্টারও বেশি। স্বাধীন দেশে লক্ষ উন্মুখ জনতার সামনে দাঁড়িয়ে তিনি বললেন-
“আমি আজ বাংলার মানুষকে দেখলাম, বাংলার মাটিকে দেখলাম, বাংলার আকাশকে দেখলাম, বাংলার আবহাওয়াকে অনুভব করলাম। বাংলাকে আমি সালাম জানাই, আমার সোনার বাংলা তোমায় আমি বড় ভালোবাসি বোধহয় তার জন্যই আমায় ডেকে নিয়ে এসেছে। আমি আশা করি দুনিয়ার সব রাষ্ট্রের কাছে আমার আবেদন আমার রাস্তা নাই, আমার ঘাট নাই, আমার খাবার নাই, আমার জনগণ গৃহহারা, সর্বহারা, আমার মানুষ পথের ভিখারী। তোমরা আমার মানুষকে সাহায্য করো, মানবতার খাতিরে তোমাদের কাছে আমি সাহায্য চাই। দুনিয়ার সকল রাষ্ট্রের কাছে আমি সাহায্য চাই। তোমরা আমার বাংলাদেশকে রিকোগনাইজ করো। জাতিসংঘের ত্রাণ দিতে হবে, উপায় নাই দিতে হবে। আমি আমরা হার মানবো না, আমরা হার মানতে জানি না। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন- ‘সাত কোটি বাঙ্গালির হে মুগ্ধ জননী রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করো নাই।’ কবিগুরুর কথা আজ মিথ্যা প্রমাণ হয়ে গিয়েছে। আমার বাঙালি আজ মানুষ। আমার বাঙালি আজ দেখিয়ে দিয়েছে দুনিয়ার ইতিহাসে এত লোক আত্মাহুতি, এত লোক জান দেয় নাই। তাই আমি বলি আমায় দাবায় রাখতে পারবা না।
এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত না পায়, এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি বাংলার মা-বোনেরা কাপড় না পায়, এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি এদেশের যুবক যারা আছে তারা চাকরি না পায়। এবং যাবার সময় বলে যাবো জয় বাংলা, স্বাধীন বাংলা, বাঙ্গালি আমার জাতি, বাংলা আমার ভাষা, বাংলার মাটি আমার স্থান।”
আমাদের একজন বঙ্গবন্ধু ছিলেন, আমাদের একজন রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন সেই কথা কি আমরা সবাই জানি?
লেখকঃ
শিবু দাশ সুমিত
সহকারী কমিশনার ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট
জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, নড়াইল।