দেশের অভিজাত এলাকায় বহুল আলোচিত দুই নাম শওকত আজিজ রাসেল ও রুবেল আজিজ ক্লাব, পার্টি, মডেলসহ নানা কারণেই সময়ে-অসময়ে আলোচনার তুঙ্গে ওঠেন তারা।
এ দুই সহোদর পারটেক্স গ্রুপের স্বপ্নদ্রষ্টা এমএ হাশেমের যমজ সন্তান। একেবারেই শূন্য থেকে ব্যবসা শুরু করেছিলেন এমএ হাশেম। চার দশকের পরিশ্রম আর সাধনায় পারটেক্স গ্রুপকে দেশের শীর্ষস্থানীয় করপোরেটে রূপ দিয়েছিলেন তিনি।
জীবদ্দশায় স্ত্রীসহ পাঁচ ছেলের মধ্যে ব্যবসা ও সম্পদ বণ্টন করে দিয়েছিলেন এমএ হাশেম।পাশাপাশি উত্তরাধিকারীদের ব্যাংকঋণের দায়দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। পিতার দেখানো পথে ব্যবসা সম্প্রসারণে সন্তানরা উদ্যোগীও হয়েছেন। যদিও উদ্যোক্তা হিসেবে সফল পিতার কনিষ্ঠ দুই সন্তান এরই মধ্যে পথ হারিয়েছেন।
ব্যবসায় মনোযোগী হওয়ার পরিবর্তে বিলাসী জীবন বেছে নিয়েছেন শওকত আজিজ রাসেল ও রুবেল আজিজ একাধিকবার গুলশান ও বনানী ক্লাবের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন তারা। রাজধানীর অভিজাত এলাকায় এ দুই সহোদরের দাপটও চোখে পড়ার মতো। যদিও ব্যাংকঋণের দায় মেটাতে একের পর এক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বিক্রি করছেন রুবেল আজিজ। অন্যদিকে ব্যবসার আকারের চেয়ে ঋণ বেড়ে যাওয়ায় চাপ বাড়ছে শওকত আজিজ রাসেলের প্রতিষ্ঠানগুলোতে।
উত্তরাধিকার হিসেবে শওকত আজিজ রাসেল পেয়েছেন পারটেক্স গ্রুপের অংশ ‘আম্বার’ বস্ত্র, সুতা, পার্টিকেল বোর্ড, কাগজ, পর্যটনসহ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ আছে আম্বারের। এ গ্রুপের এক ডজন কোম্পানির নামে দেশের বিভিন্ন ব্যাংকে ঋণ রয়েছে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা। আম্বার গ্রুপের সবচেয়ে সফল প্রতিষ্ঠান ছিল আম্বার ডেনিম মিলস লিমিটেড। যদিও গত কয়েক বছরে প্রতিষ্ঠানটির নগদ অর্থপ্রবাহের (ক্যাশ ফ্লো) তুলনায় দায় বেড়ে গেছে অনেক বেশি। গ্রুপটির অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের অবস্থাও সংকটাপন্ন।
শওকত আজিজের চেয়েও খারাপ পরিস্থিতিতে পড়েছেন তার সহোদর রুবেল আজিজ পিতার উত্তরাধিকার হিসেবে তিনি পেয়েছিলেন পারটেক্স গ্রুপের অন্তত সাতটি কোম্পানির মালিকানা। মাম পানি, আরসি কোলার মতো সুপরিচিত ব্র্যান্ডের পারটেক্স বেভারেজ লিমিটেডের পাশাপাশি তার মালিকানায় রয়েছে পারটেক্স প্লাস্টিক, জুট, কয়লা, রিয়েল এস্টেট ও তেল পরিশোধনাগার। তবে পারটেক্স বেভারেজ ছাড়া অন্য সবক’টি কোম্পানিই বর্তমানে বন্ধ হওয়ার পথে। যদিও তার কোম্পানিগুলোর নামে বিভিন্ন ব্যাংকে ঋণ রয়েছে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা।
রাসেল ও রুবেলের প্রতিষ্ঠানগুলোতে ঋণ দেয়া ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, এমএ হাশেম দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পোদ্যোক্তা ছিলেন। উদ্যোক্তা হিসেবে তার উজ্জ্বল ভাবমূর্তির কারণে ব্যাংকগুলো অনেক ক্ষেত্রে জামানত ছাড়াই ঋণ দিয়েছে। ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে পারটেক্স গ্রুপের সুনামও ছিল। কিন্তু রাসেল ও রুবেল আজিজের প্রতিষ্ঠানগুলো যে পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে, তাতে ঋণ আদায় নিয়ে শঙ্কা বাড়ছে। এরই মধ্যে ব্যাংকে এ দুই সহোদরের প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণের কিস্তি বকেয়া হতে শুরু করেছে। করোনাকালে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দেয়া নীতিছাড়ের কারণে তাদের ঋণ এ মুহূর্তে খেলাপি হচ্ছে না। তবে আগামী বছর থেকে রাসেল-রুবেলের প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ নিয়ে বিনিয়োগকারী সব ব্যাংককেই ভুগতে হবে।
রুবেল আজিজের নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে পারটেক্স পেট্রো লিমিটেড, পারটেক্স বেভারেজ লিমিটেড, পারটেক্স কোল লিমিটেড, পারটেক্স এভিয়েশন, পারটেক্স প্লাস্টিক, পারটেক্স জুট মিলস ও পারটেক্স প্রপার্টিজ লিমিটেড। এর মধ্যে পারটেক্স পেট্রো লিমিটেডের নিবন্ধন নেয়া হয় ২০১৫ সালে। নিবন্ধনের সময় পেট্রোকেমিক্যাল খাতে সম্ভাব্য বিনিয়োগের পরিমাণ ঘোষণা করা হয় ১ হাজার ৫৭৫ কোটি ৯২ লাখ টাকা। ২০১৭ সালের মধ্যেই বিনিয়োগ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সময়সীমা বিওআইয়ে উল্লেখ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। চট্টগ্রামে কর্ণফুলীর ডাঙ্গারচরে প্রকল্পটির কারখানা স্থাপন করা হয়। প্রতিষ্ঠানটির উৎপাদন শুরু হলে প্রতিদিন ১০ হাজার ব্যারেল (বিপিডি) ধারণক্ষমতার কনডেনসেট রিফাইনারি (ফ্র্যাকশন, কেএনএইচটি, সিআরইউ, পণ্য ট্যাংক ও ইউটিলিটি) নির্মিত হওয়ার কথা। যদিও উৎপাদন শুরুর সময়সীমা অনেক আগে পেরিয়ে গেলেও এখনো উৎপাদনে আসতে পারেনি তেল পরিশোধনাগারটি।
১১ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের কর্ণফুলী থানার ডাঙ্গারচরে পারটেক্স পেট্রো লিমিটেডের কারখানায় গিয়ে দেখা যায়, কর্ণফুলী নদীর তীর ঘেঁষেই কারখানাটির ভবন নির্মিত হয়েছে। গণমাধ্যমকর্মী পরিচয় দিয়ে বন্ধ থাকা কারখানাটিতে প্রবেশের অনুমতি চাইলে সেটি দেয়া হয়নি। কারখানার ভেতরে থাকা কর্মকর্তারা এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে কারখানাটির অবকাঠামো নির্মাণকাজ কয়েক বছর ধরেই চলছে বলে জানিয়েছেন দায়িত্বে থাকা নিরাপত্তারক্ষীরা। তারা জানান, পেট্রোলিয়াম পণ্য যে মেশিন দিয়ে তৈরি করা হবে সেগুলো প্রতিস্থাপনের কাজ চলছে। কারখানা চালু করার জন্য এখনো সম্পূর্ণ লোকবল নিয়োগ করা সম্পন্ন হয়নি। লোকবল নিয়োগ ও মেশিনারিজ স্থাপন করে মালিকপক্ষ খুব দ্রুতই কারখানাটি চালু করবে বলে তারা শুনেছেন।