চট্টগ্রামে কিছুদিন ধরে করোনার সংক্রমণ ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। কয়েক দিন ধরে এই বৃদ্ধির হার ২০ থেকে ২৫ শতাংশ থাকলেও গত শুক্রবার এক লাফে তা ৩৪ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। এর প্রভাব পড়েছে বন্দরনগরীর সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে। বেড়ে গেছে করোনা রোগীর চাপ।

সরকারি হাসপাতালগুলোতে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট (আইসিইউ) খালি নেই অবস্থা! বেসরকারি অনেক হাসপাতালে আইসিইউ খালি না থাকার পাশাপাশি সাধারণ শয্যাগুলোও রোগীতে পূর্ণ। এর মধ্যে কোনো কোনো হাসপাতালে সাধারণ শয্যার অতিরিক্ত করোনা রোগী চিকিৎসাধীন। সরকারি হাসপাতালে সাধারণ শয্যা ক্রমেই পূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। করোনা রোগীর চিকিৎসাসেবা দেওয়া নগরের সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন হাসপাতালে গতকাল শনিবার খোঁজ নিয়ে সর্বশেষ এমন তথ্য জানা গেছে।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, করোনা সংক্রমণ অস্বাভাবিক হারে বাড়ার সঙ্গে হাসপাতালে রোগী ভর্তির সংখ্যাও হঠাৎ বেড়ে গেছে। সংক্রমণের এই হার অব্যাহত থাকলে আগামী সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোর সব শয্যা রোগীতে ভরে যাবে।
আশঙ্কা প্রকাশ করে তাঁরা বলেন, পরিস্থিতি খুব খারাপের দিকে যাচ্ছে। গত এপ্রিল মাসেও হঠাৎ এভাবে রোগীর চাপ বাড়েনি। চলমান লকডাউনে সংক্রমণের হার কমানো না গেলে এর প্রভাব ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।
এরই মধ্যে চট্টগ্রাম জেলায় শনাক্ত ও মৃত্যুর হার বেড়ে গেছে। নগরের চেয়ে জেলায় সংক্রমণের হার অনেক বেশি। কিন্তু স্থানীয় পর্যায়ে চিকিৎসায় আইসিইউ, হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা সুবিধা না থাকায় অনেক রোগীই নগরের হাসপাতালগুলোতে ভর্তি হচ্ছে। আবার নগরসহ চট্টগ্রামের বাইরে থেকেও করোনা রোগী নগরের হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসার জন্য আসছে। সব মিলিয়ে চট্টগ্রাম নগরের সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে রোগী ভর্তি গত সপ্তাহ থেকে অনেক বেড়ে গেছে।
বন্দরনগরীতে বেসরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি করোনা রোগীর শয্যা রয়েছে আগ্রাবাদের চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালে। গতকাল বিকেল পৌনে ৩টায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এই হাসপাতালে ১৬টি আইসিইউয়ের একটিও খালি নেই। এ ছাড়া কেবিনসহ করোনা রোগীর সাধারণ শয্যা রয়েছে ১২৪টি। তার মধ্যে ১০৯টিতেই করোনা রোগী ভর্তি রয়েছে।
হাসপাতালের পরিচালক ডা. নুরুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রায় তিন মাস আগে সর্বোচ্চ ১৩৫ জন করোনা রোগী এখানে ভর্তি ছিল। চার-পাঁচ দিন ধরে রোগী ১০০-এর মধ্যে (ইনডোরে ভর্তি) ওঠানামা ছিল। আজ (শনিবার) তা ১২৫ জনে উঠে গেছে।’
বেসরকারি পার্কভিউ হাসপাতালে ৫৪টি সাধারণ শয্যায় গতকাল দুপুর পর্যন্ত ৫৮ জন করোনা রোগী চিকিৎসাধীন ছিল। একই অবস্থা বেসরকারি রয়েল হাসপাতালেও। এই হাসপাতালে ১১টি সাধারণ শয্যার মধ্যে ১২টিতেই রোগী রয়েছে। এভাবে নগরের প্রায় প্রতিটি হাসপাতালে করোনা রোগীর অত্যধিক চাপ। আর আইসিইউয়ের সুবিধা থাকা হাসপাতালগুলোতে করোনা রোগীর ঠাঁই নেই অবস্থা।
পার্কভিউ হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. রেজাউল করিম বলেন, এখানে ১০টি আইসিইউয়ের মধ্যে আটটিতেই করোনা রোগী রয়েছে। সাধারণ শয্যায় অতিরিক্ত রোগী ভর্তি রয়েছে। একই পরিবারের একাধিক সদস্য ভর্তি হলে তাদের কাউকে কাউকে শয্যাসংকটের কারণে একসঙ্গে ভর্তি দিতে হচ্ছে। শয্যার অতিরিক্ত রোগী চিকিৎসাধীন থাকায় নতুন করে ভর্তি নেওয়া হচ্ছে না।
রয়েল হাসপাতালের জেনারেল ম্যানেজার নুরুল আমিন বলেন, ‘এক সপ্তাহ ধরে করোনা রোগী ভর্তি বেড়ে গেছে। আমাদের ছয়টি আইসিইউয়ের সব কটিতে রোগী রয়েছে। ১০টি কেবিনে ১০ জন থাকলেও অন্য একটি কেবিনে স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে চিকিৎসাধীন।’
চট্টগ্রাম নগরের কভিড ডেডিকেটেড সরকারি দুই চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠান হলো চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল। এ দুটিসহ নগরসংলগ্ন সীতাকুণ্ডের ফৌজদারহাটে সরকারি বিআইটিআইডি হাসপাতালেও কয়েক দিন ধরে করোনা রোগীর চাপ বেড়েছে। চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে ১৬টি আইসিইউয়ের মধ্যে ১৫টিতে রোগী রয়েছে। ১৪০টি সাধারণ শয্যার মধ্যে গতকাল বিকেল পর্যন্ত ৬৫টি পূর্ণ ছিল।
চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের করোনা ইউনিটের প্রধান সিনিয়র কনসালট্যান্ট (মেডিসিন) ডা. আবদুর রব কালের কণ্ঠকে বলেন, গত এপ্রিলের চেয়ে এবার হাসপাতালে রোগী বেশি আসছে। এদের মধ্যে জটিল রোগী বেশি। করোনা রোগী বৃদ্ধির এই হার অব্যাহত থাকলে দুই সপ্তাহের মধ্যে হাসপাতালে শয্যা খালি থাকবে না। এর মধ্যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা না গেলে পরিস্থিতি গতবারের চেয়েও খারাপ হতে পারে।
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের আইসিইউ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হারুন অর রশিদ বলেন, হাসপাতালের ১০টি আইসিইউ ও পাঁচটি এইচডিইউ শয্যার মধ্যে রোগী ভর্তি আছে ১২ জন। এখন করোনা রোগীর সবাই আইসিইউ চাচ্ছে। এ কারণে আইসিইউয়ের ওপর চাপ বেশি। হাসপাতালে রেড জোন (করোনা রোগী) ও ইয়েলো জোনে (করোনা সন্দেহজনক) রোগী ভর্তি আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে।
চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন কার্যালয়ের গত শুক্রবারের তথ্য অনুযায়ী, বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে ৬৫০টি শয্যার মধ্যে ৪০২টিতে (৬১.৮৫%) করোনা রোগী ভর্তি রয়েছে। আর সরকারি হাসপাতালগুলোতে ৯৫০ শয্যার মধ্যে ২৪০ জন (২৫.২৬%) রোগী আছে। সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে থাকা মোট ১৫০টি আইসিইউয়ের মধ্যে ৮০টিতেই রোগী চিকিৎসাধীন।
Discussion about this post