কভিড-১৯ অতিমারীর প্রথম ধাক্কায় অর্থনীতিতে অভূতপূর্ব বিপর্যয় নেমে আসে। মানুষের জীবন ও জীবিকা বড় ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে। অধিকাংশ মানুষ কাজ হারিয়েছে। ১৯৯২ সালের পর এই প্রথম নতুন করে দারিদ্র্য বেড়েছে। স্বাস্থ্য খাতের সঙিন দশা আরো স্পষ্ট হয়েছে। শিক্ষা খাত পিছিয়ে পড়ছে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি সবার জন্য না থাকায় অধিকাংশ মানুষের দুর্ভোগ আরো বেড়েছে। নিম্ন আয়ের মানুষ, দরিদ্র, মধ্যবিত্ত, বৃদ্ধ, শিশু, নারীসহ সমাজের দুর্বল ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মধ্যবর্তী শ্রেণীগুলো ভাঙনের শিকার হয়েছে। প্রথম ধাক্কাই তারা সামলাতে পারেনি। সঞ্চয়, আয় যা ছিল সব ফুরিয়েছে। খানাগুলোর দ্বিতীয় ধাক্কা মোকাবেলা করার মতো সক্ষমতা অবশিষ্ট নেই। মূলত যেকোনো অভিঘাতে অধিকাংশ মানুষের ঝুঁকি প্রশমনের সক্ষমতা অনেক কম বলেই দারিদ্র্য বাড়ছে।
সরকার অর্থনীতির সংকোচন রোধে প্রণোদনা ঘোষণা করেছে। তবে প্রতিটি ব্যক্তি হাতে ও কারবারে নগদ অর্থ আশানুরূপ পৌঁছতে পারেনি। রফতানিমুখী ও বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানে প্রণোদনার বরাদ্দকৃত অর্থ বাস্তবায়নের অগ্রগতি দ্রুত হয়েছে। কিন্তু কুটির, অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাত এবং কৃষি খাতে খুবই মন্থর। অথচ এসব খাতেই সবচেয়ে বেশি মানুষ নিয়োজিত। ফলে অধিকাংশ মানুষ বঞ্চিত থেকে গেছে। বিপরীতে সম্পদ কিছু মানুষের হাতে কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। এ কারণে অর্থনীতি বৈষম্যমূলক পুনরুদ্ধারের পথে এগোচ্ছে। পুনরুদ্ধার নীতি-কাঠামোর অনুমিতি নির্ধারণে কিছু ঘাটতি দৃশ্যমান। ফলে অর্থনীতির কাঙ্ক্ষিত পুনরুদ্ধার সম্ভব হচ্ছে না। এখানে ২০২০-২১ অর্থবছরে কভিড-১৯-এর প্রথম ও দ্বিতীয় ধাক্কায় অর্থনীতির সংকোচনের স্বরূপ উন্মোচনের পাশাপাশি প্রচলিত নীতি-কাঠামোর সীমাবদ্ধতাগুলো বিশ্লেষণ করা হয়েছে। তারই আলোকে একটি সমতাভিত্তিক ও টেকসই পুনর্বাসন ও পুনরুদ্ধার নীতি-কাঠামোর রূপরেখা তুলে ধরা হয়েছে।
গতানুগতিক নীতি-কাঠামো থেকে বেরোতে হবে
বিশ্বব্যাপী কভিড-১৯ অতিমারীর অভিঘাত থেকে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সামগ্রিক চাহিদা বৃদ্ধির জন্য সম্প্রসারণশীল নীতি-কাঠামো নেয়া হয়েছে। রাজস্ব ও মুদ্রানীতির মাধ্যমে ব্যক্তি হাতে ও কারবারে সরাসরি নগদ অর্থ সরবরাহ করা হচ্ছে। উন্নত দেশগুলো গড়ে মোট দেশজ উৎপাদনের ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ প্রণোদনা অর্থ সরবরাহ করেছে। বাংলাদেশে লক্ষ করা গেছে, কভিড-১৯ অভিঘাতের মধ্যেও সরকার গতানুগতিক নীতি-কাঠামো থেকে বের হতে পারেনি। সবাই যখন সম্প্রসারণশীল রাজস্ব নীতির আশ্রয় নিচ্ছে, বাংলাদেশে তখন রাজস্ব ব্যয় আরো কমেছে।
সরকার মনে করেছে অর্থনীতি খুব দ্রুতই অতিমারীর রেশ কাটিয়ে আগের অবস্থানে ফিরে যাবে। কিন্তু দ্বিতীয় বা তৃতীয় ঢেউয়ের তীব্র আঘাত আসতে পারে এবং তাতে অর্থনীতি আরো বেশি সংকুচিত হতে পারে এ রকম অনুমান করা হয়নি। ধরে নেয়া হয়েছিল এক বছরের মধ্যেই অতিমারী নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে। তাই স্বল্পমেয়াদি নীতিমালাই গ্রহণ করা হয়েছে। যদিও টেকসই পুনরুদ্ধারে প্রয়োজন ছিল মধ্যমেয়াদি নীতিমালা ও সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা। ঘোষিত প্রণোদনা বিশেষ পরিস্থিতিতে অ্যাডহক ভিত্তিতে মুদ্রানীতির মাধ্যমে নেয়া হয়েছে। বেশির ভাগ ঋণভিত্তিক। প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার ঘাটতির কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত খানা ও কারবারগুলোতে অর্থ যায়নি। ফলে তাদের দুর্ভোগ কমেনি এবং অধিকাংশ মানুষ দারিদ্র্যের কাতারে চলে যাচ্ছে।
বৈষম্যমূলক পুনরুদ্ধার
নীতি-কৌশলের বৈষম্যমূলক প্রভাবের কারণে উল্লম্ব দিকে আর করোনার মতো মহামারী, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদি অভিঘাতে অনুভূমিক দিকে সামাজিক পার্থক্য বাড়ছে। পিছিয়ে পড়া, দুর্বল, ঝুঁকিপ্রবণ দরিদ্র জনগোষ্ঠী, মধ্যবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্তরা ক্রমেই প্রান্তিক হয়ে পড়ছে। সম্পদ ওপরের দিকের কিছু ব্যক্তির হাতে কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, মহামারীর মধ্যেই কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছে ৩ হাজার ৪১২ জন। এক দশকে ধনকুবেরের সংখ্যা বৃদ্ধির হারে শীর্ষে বাংলাদেশ। বিপরীতক্রমে দারিদ্র্য হার ও বৈষম্য বাড়ছে এবং মেরুকরণ ত্বরান্বিত হচ্ছে।
প্রণোদনা প্যাকেজের বেশির ভাগই গিয়েছে রফতানিমুখী আর বৃহৎ কিছু শিল্পের হাতে। অন্যদিকে অনানুষ্ঠানিক খাত, কুটির, অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাত (সিএমএসএমই) আর কৃষি খাত উপেক্ষিত রয়ে গেছে। ফলে বৈষম্য বাড়ছে। পুনরুদ্ধারের গতিপথ ইংরেজি কে অক্ষরের চেহারা ধারণ করছে। অর্থাৎ একদিকে সম্পদ কিছু মানুষের হাতে যাচ্ছে, অন্যদিকে অধিকাংশ মানুষের আয় কমছে। মধ্যবর্তী শ্রেণীগুলোর একটি অংশ ক্রমেই প্রান্তিক হয়ে পড়ছে এবং দরিদ্রের কাতারে চলে যাচ্ছে। আরেকটি অংশ রাষ্ট্রক্ষমতার (অপ)ব্যবহার করে বা কাছাকাছি থেকে যেকোনো প্রক্রিয়ায় অর্থোপার্জনে নিয়োজিত এবং উচ্চবিত্তের কাতারে যাচ্ছে। অন্য ক্ষুদ্র অংশটি কোনো রকমে টিকে আছে। এ ভাঙনের কারণে সামাজিক কাঠামোয় বড় ধরনের পরিবর্তন হচ্ছে। রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তাদের বলিষ্ঠ অবদান ও নেতৃত্ব ক্রমান্বয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছে। রাজনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ায় তারা নীতি-কৌশল প্রণয়নে তেমন প্রভাব রাখতে পারছে না।
রাজস্ব ব্যয় বিগত বছরের তুলনায় কম
২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট পরিমাণে বাড়লেও প্রধান খাতগুলোতে বিগত বাজেটের তুলনায় কম বরাদ্দ পেয়েছে। বিগত বছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৩ শতাংশ হ্রাস পেলেও বাজেটে জিডিপির তুলনায় এডিপি বা বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূাচতে বরাদ্দ কমেছে ৫ শতাংশ। এর সঙ্গে রয়েছে সরকারের অতি নিম্ন বাজেট বাস্তবায়নের হার। ২০২১ সালের এপ্রিল পর্যন্ত সরকার বাজেট বাস্তবায়ন করতে পেরেছে মাত্র ৪৪ শতাংশ। আর বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের হার মাত্র ২৯ শতাংশ। বাজেট বাস্তবায়নের গড় হার ৮৫ শতাংশ অর্জন করতে হলে সরকারকে অর্থবছরের শেষ দুই মাসে প্রায় ৪০ শতাংশ অর্থ ব্যয় করতে হবে, যা অসম্ভব। বোঝাই যাচ্ছে অর্থ ছিল পর্যাপ্তই কিন্তু তা ব্যবহার করা যায়নি। বাংলাদেশে প্রবৃদ্ধির একটি বড় অংশই এসেছে সরকারি ব্যয় থেকে। কিন্তু করোনাকালের অভিঘাত মোকাবেলায় যেখানে সরকারি ব্যয় কয়েক গুণ বাড়ানোর কথা সেখানে তা আগের তুলনায় কমেছে। ফলে অর্থনীতি আরো সংকুচিত হয়েছে। প্রবাসীদের পাঠানো অভিবাসী এবং কৃষি খাতের অপেক্ষাকৃত ভালো উৎপাদন অর্থনীতির চাকাকে এখনো ধরে রেখেছে। এ দুই উেসর অবস্থা খারাপ হলে অর্থনীতি আরো বেশি সংকোচনের শিকার হতো।
অত্যধিক তারল্য সত্ত্বেও ঋণপ্রবাহ সামান্য
সরকার ব্যাংক ব্যবস্থার মাধ্যমে ঋণপ্রবাহ বাড়াতে অর্থের সরবরাহ বাড়িয়েছিল। করোনার মধ্যেই দেশে অধিক পরিমাণ অভিবাসী আয় এসেছে। বিদেশী সাহায্য পেয়েছে। ফলে তারল্য বেড়েছে। কিন্তু অধিক তারল্য থাকা সত্ত্বেও ঋণপ্রবাহ বাড়ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণপ্রবাহের লক্ষ্যমাত্রা ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ ঘোষণা করলেও অর্জন হয়েছে মাত্র ৮ শতাংশ। বড় প্রতিষ্ঠাণ ঋণ পেলেও নানা বাধার কারণে ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণ পাচ্ছে না। দেখা যাচ্ছে অর্থ থাকা সত্ত্বেও নতুন বিনিয়োগ হচ্ছে না। ফলে কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে না। ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের হার কমেছে। অন্যদিকে রাজস্ব ব্যয়ও কমেছে। এ কারণে অর্থনীতির সংকোচন থেকে আশানুরূপ উত্তরণ হচ্ছে না।
প্রণোদনা অর্থ বণ্টনে বৈষম্য
সব অর্থনৈতিক খাতের জন্য প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হলেও খুব অল্পসংখ্যক খাতই সঠিকভাবে তা পেয়েছে। সরকার মোট ১ লাখ ২৮ হাজার ৫৩ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে মার্চ ২০২১ পর্যন্ত সরবরাহ করা হয়েছে ৭৭ হাজার ৪৭১ কোটি টাকা। সর্বমোট বাস্তবায়ন অগ্রগতির হার ৬০ দশমিক ৩ শতাংশ। এ প্রণোদনার ৮০ দশমিক ৭ শতাংশই ঋণভিত্তিক। মাত্র ১৯ দশমিক ৩ শতাংশ রাজস্ব প্রণোদনা। রফতানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার বিশেষ তহবিলের পুরোটাই তারা পেয়েছে। অথচ কৃষিকাজ যান্ত্রিকীকরণে বরাদ্দকৃত ৩ হাজার ২২০ কোটি টাকার মধ্যে বাস্তবায়িত হয়েছে মাত্র ২৪৩ কোটি টাকা। কৃষি ভর্তুকির ৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকার মধ্যে সরবরাহ হয়েছে মাত্র ৩ হাজার ৭৭৬ কোটি টাকা। এসএমই খাতের জন্য ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম ২ হাজার কোটি টাকা, বয়স্ক ভাতা ও বিধবা ভাতা ১৫০টি উপজেলায় সম্প্রসারণে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে লক্ষ্যভিত্তিক জনগোষ্ঠীর মাঝে নগদ অর্থ বিতরণে ৯৩০ কোটি টাকা বরাদ্দের মধ্যে মার্চ ২০২১ পর্যন্ত এক টাকাও সরবরাহ করা হয়নি। অন্যদিকে তৈরি পোশাক ও চামড়া খাতের শ্রমিকদের সহায়তার জন্য বরাদ্দকৃত ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকার মধ্যে সরবরাহ হয়েছে মাত্র ৬ কোটি টাকা। প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ও নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বরাদ্দকৃত ১ হাজার ৫০০ কোটির টাকার মধ্যে সরবরাহ হয়েছে মাত্র ৫৭০ কোটি টাকা। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর কাছে প্রণোদনার অর্থ পৌঁছতে পারেনি। ফলে তাদের দুর্ভোগ কমানো যায়নি। বরং দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রে আটকে যাচ্ছে।
নতুন দারিদ্র্য ও বৈষম্য বৃদ্ধি
অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করা প্রায় ২১ দশমিক ৪ শতাংশ জনগোষ্ঠী আয় হ্রাস ও বেকারত্বের শিকার হয়েছে। অন্য খাতের শ্রমিকরা একই পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়। বিভিন্ন হিসাব বলছে, কভিডের কারণে দারিদ্র্য বেড়ে ৪০ শতাংশের ওপরে উঠেছে। উন্নয়ন অন্বেষণের হিসাব বলছে, লকডাউন পরিস্থিতি আরো বাড়তে থাকলে দারিদ্র্য বৃদ্ধি পেয়ে ৪৭ শতাংশে দাঁড়াবে। একই সঙ্গে আয়বৈষম্য বেড়েছে সমাজের ওপর আর নিচতলার মানুষের। সিপিডির হিসাব বলছে, জনসংখ্যার সর্বনিম্ন আয়ের ১০ শতাংশ মানুষের আয়ের অংশ কভিডের আগে ছিল ৩ দশমিক ৩৫ শতাংশ। কভিডের কারণে তা নেমে দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশে। নতুন দারিদ্র্য ও বৈষম্য বৃদ্ধির কারণে ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনও হুমকিতে পড়বে।
স্বাস্থ্য খাতে ব্যক্তিগত খরচ অত্যধিক
কয়েক বছর ধরে স্বাস্থ্য খাতের মাত্র ২৭ শতাংশ খরচ আসে বাজেট থেকে আর বাকি টাকা আসে জনগণের পকেট থেকে। ২০১৬ সালের খানা জরিপ অনুযায়ী স্বাস্থ্যসেবায় উচ্চমাত্রার ব্যক্তিগত খরচ ২ দশমিক ৬৯ শতাংশ মানুষকে চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে এবং ৪ দশমিক ৫০ শতাংশ মানুষকে দারিদ্র্যসীমার নিচে ঠেলে দেয়। বেসরকারি হাসপাতালে রোগীর সেবা এবং নিবিড় পরিচর্যার খরচ সরকারি হাসপাতালের চেয়ে যথাক্রমে ৮৯ ও ২৫ শতাংশ বেশি। সরকারি হাসপাতালগুলোতে একজন কভিড রোগীর পেছনে গড়ে ব্যয় হয়েছে ১ লাখ ২৮ হাজার ১১৯ টাকা। বেসরকারি হাসপাতালে প্রতি রোগীর পেছনে খরচ হয় ২ লাখ ২২ হাজার ৭৪ টাকা। সরকারি হাসপাতালের প্রায় দ্বিগুণ। সরকারি হাসপাতালে ধারণক্ষমতা কম থাকার কারণে অনেককেই বাধ্য হয়ে বেসরকারি হাসপাতালের অধিক খরচ বহন করতে হয়। এভাবে দারিদ্র্য পরিস্থিতি আরো ঘনীভূত হচ্ছে। অন্যদিকে সময়মতো টিকা প্রাপ্তির বিষয়টি এখনো অনিশ্চিত। এ পর্যন্ত বাংলাদেশের ৫ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ টিকা গ্রহণ করেছে। ভারতে এ হার ১২ দশমিক ৭ শতাংশ এবং নেপালে ৮ দশমিক ৭ শতাংশ।
শিক্ষা জীবন অপচয়ে উৎপাদনশীলতা হ্রাস
দীর্ঘ ছুটির কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো অনলাইনে ক্লাস নেয়া শুরু করে। বাংলাদেশের শুধু ১৩ শতাংশ মানুষ ইন্টারনেটের আওতায় আছে। ইউনিসেফের মতে, ৩ কোটি ৬৮ লাখ শিক্ষার্থী সব অনলাইন ক্লাস ও নির্দেশনা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। শিক্ষার্থীরা শিক্ষা জীবনের ৫ দশমিক ৫ মাস বা প্রায় অর্ধেক বছর হারাচ্ছে। এ পরিমাণ শিক্ষা জীবন অপচয়ের কারণে দীর্ঘমেয়াদে একজন শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা হ্রাস পাবে প্রায় ১৩ শতাংশ। দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতির ক্ষতি হবে জিডিপির প্রায় ৩৩ শতাংশ। বিশ্বব্যাংক বলছে, সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে ১১৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতি হবে। আর পরিস্থিতি উন্নতির দিকে গেলেও দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতি হবে ৬৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অনলাইন শিক্ষায় বঞ্চনার অন্যতম কারণ দুর্বল নেটওয়ার্ক ও উচ্চমূল্যের ইন্টারনেট খরচ। বাংলাদেশে ১ গিগাবাইট ইন্টারনেটের মূল্য প্রায় ১ ডলার। ভারতে এর মূল্য মাত্র দশমিক ২৬ ডলার। ইন্টারনেট খরচ নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন হলেও তা করা হচ্ছে না। আবার পর্যাপ্ত টিকার ব্যবস্থা করতে না পারায় এখনই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেয়ার সম্ভাবনা কম।
প্রয়োজন পূর্ণ জীবন চক্রভিত্তিক সর্বজনীন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি
এশিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে প্রায় ৬১ শতাংশ মানুষ কোনো সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় নেই। আফ্রিকায় এ হার প্রায় ৮২ শতাংশ। বাংলাদেশেও এ পরিস্থিতির ব্যতিক্রম নয়। সামাজিক সুরক্ষা ভাতা অনেক ক্ষেত্রেই উপযুক্তরা পাচ্ছে না। কিছু ক্ষেত্রে যারা পাচ্ছে তারা সামাজিক সুরক্ষা পাওয়ার উপযুক্ত নয়। বরাদ্দকৃত অর্থ নতুন যোগ হওয়া দরিদ্রের দুর্ভোগ মেটাতে পর্যাপ্ত নয়। বিদ্যমান কর্মসূচিগুলো সর্বজনীন নয়। কিছু নির্দিষ্ট শ্রেণীর মানুষকে ভাতা বা সহায়তা দেয়া হয়। ফলে সুবিধাভোগী বাছাই করা হয় রাজনৈতিক বিবেচনায়। সরকারি প্রতিবেদনই বলছে, যোগ্য না হয়েও সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির ভাতা নেয় ৪৬ শতাংশ সুবিধাভোগী। আবার জনসংখ্যার পূর্ণাঙ্গ তথ্য ব্যবস্থার ঘাটতি রয়েছে। ফলে প্রকৃত সুবিধাভোগ বাছাই করা কঠিন হচ্ছে এবং সবার কাছে সহায়তা যাচ্ছে না।
করোনার অভিঘাতে প্রতিটি খানা ক্ষতিগ্রস্ত। পূর্ণ জীবন চক্রভিত্তিক সর্বজনীন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির যেকোনো অভিঘাতে খানাগুলোর ঝুঁকি হ্রাসের সক্ষমতা বাড়ানো যাবে। সর্বজনীন পেনশন ভাতা, বেকার ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, শিশু প্রতিপালন ভাতা, আবাসন সুবিধা, আয়সহায়ক ভাতা ও স্বাস্থ্য ভাতা—এ সাতটি কর্মসূচি নেয়া যেতে পারে। এজন্য বাংলাদেশের মোট প্রয়োজন জিডিপির ২০ শতাংশ বরাদ্দ।
উন্নয়ন অন্বেষণের হিসাব মতে, ২৫ শতাংশ দরিদ্র পরিবারের শিশুদের সামাজিক সুরক্ষার আওতায় আনার জন্য প্রয়োজন জিডিপির ১২ দশমিক ৯ শতাংশ বরাদ্দ। সব দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মাঝে বয়স্ক ভাতা দেয়ার জন্য বরাদ্দ প্রয়োজন ২ দশমিক ১৮ শতাংশ। দরিদ্রদের মাঝে বেকার ভাতার জন্য প্রয়োজন জিডিপির ২ দশমিক ১৪ শতাংশ। প্রতিবন্ধী ও মাতৃত্ব ভাতার জন্য প্রয়োজন জিডিপির দশমিক ৮৯ ও দশমিক ৩০ শতাংশ বরাদ্দ (সারণি দ্রষ্টব্য)। ভিয়েতনাম ও শ্রীলংকার মতো দেশগুলো জিডিপির ৬ শতাংশেরও বেশি ব্যয় করে সামাজিক সুরক্ষা খাতে। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো ব্যয় করে ২০ শতাংশের বেশি। অথচ বাংলাদেশ ব্যয় করে ২ শতাংশ মাত্র।
অর্থনীতির কাঠামোগত রূপান্তর হয়নি
এখনো কর্মসংস্থানের সবচেয়ে বড় উৎস অনানুষ্ঠানিক খাত। দেশের ৮০ ভাগ শ্রমিকই কাজ করে অনানুষ্ঠানিক খাতে। গত কয়েক বছরে সিএমএসএমই একমাত্র খাত যেখানে সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে। এ খাতের শ্রমিকদের কোনো চাকরির নিরাপত্তা বা স্বাস্থ্য বীমা নেই। অথচ প্রণোদনা প্যাকেজের বেশির ভাগই গিয়েছে বড় শিল্প খাতের মালিকদের হাতে। দেশের প্রায় ৪০ ভাগ শ্রমিকই এখনো কৃষি খাতে নিয়োজিত। অথচ কৃষি খাতই সবচেয়ে কম প্রণোদনা পেয়েছে। এমন অসম বণ্টন ও বিতরণ দেশের অর্থনীতিতে বিদ্যমান বৈষম্যকে আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে।
কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের উৎপাদনশীলতায় তেমন পরিবর্তন আসেনি। দেশের সামগ্রিক উৎপাদন উপকরণের গড় উৎপাদনশীলতা দশমিক ২। আমেরিকা ও পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে তা যথাক্রমে দশমিক ৮ ও ১ দশমিক ৩। অল্প কিছু শিল্পের ওপর অতি নির্ভরশীলতার ফলে কভিডের অভিঘাত অসমভাবে পড়েছে। রফতানি পণ্যের ৮৮ শতাংশই পোশাক ও টেক্সটাইল পণ্য। আবার পোশাক ও টেক্সটাইল পণ্যেও বৈচিত্র্যের ঘাটতি রয়েছে। তৈরি পোশাক রফতানির ৬৮ শতাংশ মাত্র ১০ রকম পোশাকে সীমাবদ্ধ। রফতানি বাজার পশ্চিম ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় কেন্দ্রীভূত। রফতানিকারক দেশগুলোর অর্থনীতিতে যেকোনো অভিঘাত এলেই ক্রয়াদেশ কমে যায়। করোনা অভিঘাতের প্রথম ধাক্কায় ১১৫০টি কারখানায় ৩১৮ কোটি ডলার মূল্যের ক্রয়াদেশ বাতিল হয়। দ্বিতীয় ধাক্কার প্রথম কয়দিনেই ৫০টি বড় কারখানার অর্ডার ৩০ শতাংশ কমেছে।
কর্মসংস্থান, বিনিয়োগ ও প্রতিযোগিতাশীলতায় নজর নেই
অর্থনীতির ভারসাম্য রক্ষার জন্য প্রয়োজন কর্মসংস্থান, বিনিয়োগ ও প্রতিযোগিতাশীলতা। সরকারের নীতি-কাঠামোতে এগুলো তেমন প্রাধান্য পায়নি। বেকারত্ব হ্রাসের জন্য চীন-ভিয়েতনামের মতো দেশগুলো যুবসমাজকে নানা রকম প্রশিক্ষণ দেয়। কিন্তু এমন পদক্ষেপ বাংলাদেশে অপর্যাপ্ত। কভিডের ফলে প্রায় ৬০ শতাংশ শ্রমশক্তি চাকরি হারায়। বেশির ভাগই অনানুষ্ঠানিক খাতে চাকরি করে খুব কম প্রশিক্ষণ ও শিক্ষা নিয়ে। ফলে অর্থনৈতিক মন্দার চাপে বেকারত্ব বৃদ্ধি পেলে এরা অন্যান্য খাতে স্থানান্তরিত হতে পারে না। পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ থাকলে দক্ষতা অনুযায়ী ঘরে বসেই অন্যান্য অনেক কাজ করতে পারত।
বেসরকারি ও বিদেশী বিনিয়োগের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক বাধা। বাংলাদেশ প্রতিযোগিতাশীলতা নির্ধারণকারী ইজ অব ডুয়িং বিজনেস তালিকায় ১৬৮তম। দেশের বিদ্যুৎ সরবরাহ আগের চেয়ে ভালো অবস্থায় থাকলেও সময়মতো চুক্তি কার্যকর করা, সম্পত্তির মালিকানা স্থানান্তর ও বাণিজ্যিক বিরোধ নিষ্পত্তি করার ক্ষেত্রে দুর্বল অবস্থার কারণে বিনিয়োগের পরিবেশ উন্নত হচ্ছে না। কাঠামোগত রূপান্তর করে অর্থনীতিতে ভারসাম্য ফিরিয়ে আনার জন্য প্রয়োজন এসব প্রাতিষ্ঠানিক বাধা দূর করা।
উপসংহার
করোনার অভিঘাত বিশ্বব্যাপী সমাজ ও অর্থনীতির স্বরূপ অনেকাংশে পাল্টে দিয়েছে। বিদ্যমান নানা অসংগতিকে আরো স্পষ্ট করেছে। নীতিনির্ধারণে গতানুগতিক ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতাকে তুলে ধরেছে। অধিকাংশ দেশ আগের ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে নতুন করে ভাবছে এবং পুনরুদ্ধার নীতি-কাঠামোয় সংখ্যাগরিষ্ঠদের প্রাধান্য দিয়ে টেকসই ব্যবস্থার দিকে ধাবিত হচ্ছে। তারই আলোকে সম্প্রসারণশীল নীতিমালা প্রণয়ন করছে। সমতাভিত্তিক টেকসই পুনর্বাসন ও পুনরুদ্ধারের জন্য বাংলাদেশকেও একই ব্যবস্থা নিতে হবে। আসন্ন বাজেটে নতুন ঢেউয়ের অভিঘাত মোকাবেলা এবং ঝুঁকি প্রশমনের সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য প্রতিটি খানায় সরাসরি নগদ অর্থ পৌঁছাতে হবে। সর্বজনীন স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে যেকোনো অভিঘাতে মানুষের ঝুঁকি প্রশমনের সক্ষমতা বাড়ে এবং দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র থেকে বেরিয়ে আসতে পারে। নীতি-কৌশলে সবচেয়ে বেশি মানুষ নিয়োজিত খাতগুলোকে অধিক প্রাধান্য দিতে হবে। কুটির, ক্ষুদ্র, অতিক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতে সহায়তা বাড়াতে হবে। রফতানিমুখী শিল্পের উৎপাদনে ও বাণিজ্যে বৈচিত্র্য নিশ্চিত করতে হবে। শ্রমিকের দক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে। নতুন বিনিয়োগ বাড়ানোর মাধ্যমে কর্মসংস্থান ধরে রাখতে হবে। তবেই মানুষের জীবন ও জীবিকার নিরাপত্তা দেয়া সম্ভব হবে। অর্থনীতি একটি সমতাভিত্তিক টেকসই পুনরুদ্ধারের পথে এগোবে।
ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর: অধ্যাপক, উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারপারসন, উন্নয়ন অন্বেষণ
মো. শাহ পরান, আদরিনা ইবনাত জামিলী আদিবা, ওয়াহিদ হায়দার, মো. রাকিব হোসাইন ও আশিক সূফী ইসলাম: গবেষক, উন্নয়ন অন্বেষণ
Discussion about this post